লম্বালাঠি কামার, পানু গুছাইত আর প্রস্তর ধর - পোর্তুগিজ লোককথা

এক গ্রামে এক কামার ছিলো, তার গায়ে ছিলো প্রবল শক্তি। তার এক হাতুড়ির ঘায়ে আর একবার হাপরের বেলোতে বড়বড় লোহার জিনিস প্রায় তৈরি হয়ে যেতো। যা কেউ একা বইতে পারতো না, চার পাঁচজন লোকে বয়ে নিয়ে যেতো, সেই সব জিনিস সে একাই বাঁ হাতে তুলে বাড়িবাড়িতে দিয়ে আসতে পারতো। কিন্তু সে বড় বদমেজাজী ছিলো। বাড়িতে ছিল তার সুন্দরী বউ আর ছোট্ট একটি ছেলে। কিন্তু সারাদিন পরিশ্রমের পরে ঘরে ঢুকে ছেলেকে কাঁদতে দেখলেই তার মেজাজ গরম হয়ে যেতো। বৌকে সবসময় ধমকে কথা বলত সে। বেচারা বৌটি ভয়ে ভয়ে থাকত সবসময়। জানেই তো তার স্বামীর গায়ে প্রবল শক্তি। কিন্তু তারও সহ্যশক্তির একটা সীমা আছে। একদিন অকারণে অনেক ধমক খেয়ে মন শক্ত করলো সে। পরের দিন কামার বেরিয়ে কামারশালায় যেতেই ছেলেকে কোলে নিয়ে বাড়ি থেকে পালালো বৌটি।
বনের মধ্যে কুটির বাঁধল বৌটি। কোনো গ্রামে যেতে ভরসা পেলো না, যদি খবর পেয়ে আবার কামার তাকে নিয়ে যেতে আসে। বনের ফল আর বাদাম খেয়ে ছেলে বড় হতে থাকল। সে বাবার থেকেও বেশি শক্তিশালী হল, মায়ের মতো ভালো মনের মানুষ হল। একসময়ে সে বড়বড় পাথর তুলতে লাগল, বড়বড় গাছ উপড়ে ফেলতে লাগল।
সে যখন আঠারো বছর বয়স হল, একদিন সে তার মা কে বলল, “মা আমি আমাদের গাঁয়ে যেতে চাই একবার। এতো গল্প শুনেছি তোমার মুখে, একবার গাঁয়ে গিয়ে দেখতে চাই। তোমার কি খুব দুঃখ হবে তাতে?"

অনেকদিন আগেই মায়ের মনে হচ্ছিল ছেলে যেকোনো সময় এইকথা বলবে। তাই একটু দুঃখ পেলেও সাথেসাথেই অনুমতি দিলো সে।
গ্রামে পৌঁছেই সবার আগে সে কামারশালায় গেলো। মা এতোবার গল্প করেছে যে তার চিনতে কোনো অসুবিধাই হল না। সে তার পিতাকেও তৎক্ষণাৎ চিনতে পারল, মনে মনে সে এইরকম একটা মানুষেরই ছবি এঁকেছিল।
-"আমি একটা কাজের বায়না নিয়ে এসেছি", সে বললো।
-"কি করতে হবে বলুন?" কামার বলল।
-"আমাকে লোহা দিয়ে একটা লম্বা লাঠি বানিয়ে দিতে হবে। আপনার উঠোনের সবথেকে লম্বা গাছটার সমান।"
কামার একটু হাসল, তারপর একবার ছোকরার দিকে তাকাল, একবার সবথেকে লম্বা গাছটার।
-”মাপে নিশ্চয়ই তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে হে ছোকরা।” সে বলল
- “আপনি ঠিকই ধরেছেন, মাপে ভুল হয়ে গেছে। আসলে এই গাছটার দ্বিগুণ লম্বা একটা লাঠি চাই। লাঠিটা যেন একটু শক্তপোক্ত হয়, কারণ আমি সেটা নিয়ে বেড়াতে বেরোবো।”
কামার যেন আরেকটু ভালো করে ছোকরাকে দেখে নিলো। হুম, এ ছেলে হয়তো এই লাঠি নিয়ে চলতে পারবে। আর তারও জেদ চেপে গেছে। সে লাঠি বানাতে রাজি হয়ে গেলো, এমনকি আগাম মজুরী নিতেও ভুলে গেলো উৎসাহের চোটে।
-”আগামি সপ্তাহে আমি লাঠি নিতে আসব” বলল ছেলেটি, তারপর ফিরে গেলো মায়ের কাছে।
বাড়ি ফিরে মাকে জানালো, "আমি যখন পরের সপ্তাহে লাঠিটা আনতে যাব, তুমিও আমার সাথে যাবে।"
"আমি?" মা ভয়ে কেঁদে ফেলল। "তুমি যে কামারের বর্ণনা দিয়েছ, তা অনুসারে সে আমারই স্বামী, আমি ওঁকে ভয় পাই। হয়তো এতো বছরেও ওঁর মেজাজ ঠিক হয়নি।"
-"না না, শুধু শুধু ভয় পেও না মা। নরম গলায় ছেলে বলল। আমি তো আছি।"
এক সপ্তাহ পর সে আর তার মা দুজনেই গেলো গ্রামে। একটা বড় ঝোপের আড়ালে মা কে অপেক্ষা করতে বলে সে গেলো কামারশালায়।
-"সুপ্রভাত, আমার লাঠিটা কি তৈরি হয়েছে?"
-"একদম, সম্পুর্ণ তৈরি। আমি কিছু গরুরগাড়ি আর লোকজন ডাকছি, তারা কামারশালা থেকে লাঠিটা বার করতে সাহায্য করবে।"
-"না না কাউকে কষ্ট করে আসতে হবে না।" সে লাঠিটা নিয়ে একটা লিকলিকে বেতের মতো কয়েকবার বাতাসে নেড়েচেড়ে দেখলো। দেখে মনেই হবে না ওর কিছু ওজন আছে। কামার হাঁ করে তাকিয়ে দেখলো, তার চোখ প্রায় ঠিকরে বেরিয়ে আসে আসে… কি অসামান্য শক্তি এই ছেলের!
-"তুমি কে সেটা আমি কি জানতে পারি?" মোলায়েম ভাবে জিজ্ঞাসা করল কামার। এতো মোলায়েম ভাবে সে দীর্ঘকাল কথা বলেনি।
-"আজ থেকে আমার নাম লম্বালাঠি। আর আমি তোমার নিজের ছেলে, তাই পুরো নাম লম্বালাঠি কামার।"
এই বলে সে তার আর তার মায়ের গল্প বলল। কামার অবাক হয়ে শুনল, শেষে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "আমি তোমার মত সন্তানের বাবা হতে পেরে গর্বিত। তুমি আমার সাথে থাকতে পারো যদি চাও। আমরা একসাথে আনন্দে থাকব।"
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল সে। "নাহ, আমি এখানে থাকতে পারব না, আমি একটু দুনিয়া দেখতে চাই। আমার মাকে আমি একটা ঝোপের আড়ালে অপেক্ষা করতে বলে এসেছি। আমি চলে গেলে তিনি একা পড়ে যাবেন। তিনি আপনার সাথে থাকতে পারেন।" বাবার সম্মতি পেয়ে মা কে এক ডাক দিলো ছেলে।
"মা ঘরে আসতেই বাবা তাকেও জড়িয়ে ধরল, আর খুব নরমভাবে বলল তুমি চলে যাওয়ার পর বাড়িটা একদম ফাঁকা হয়ে গেছিলো। আমি তোমাকে খুব মিস করেছি।"
বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে লম্বালাঠি বাবার দিকে তাকালো। "গতবারের মত এবারেও যদি তুমি আমার মা কে দুঃখ দিয়েছ, আমার সাথে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকবে।"
লম্বালাঠি দুনিয়া দেখতে বেরোলো। এইদেশ থেকে ওইদেশ ঘুরছে, একদিন এক জায়গায় দেখলো, একটা লোক বড়বড় পাইনগাছ তুলে একজায়গায় গুছিয়ে রাখছে, যেন বাগানের আগাছা।
লম্বালাঠি জিজ্ঞাসা করল, "ভাই, তোমার নাম কি?"
-"আমার নাম প্রণব গুছাইত, তবে আমি পাইনগাছ গুছিয়ে রাখি তাই লোকে আমায় পানু গুছাইত বলে ডাকে। আপনি দেখতেই পাচ্ছেন আমি যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে আমার থেকেও বেশি শক্তিশালী একজনের খোঁজ আমি করছি, তার নাম শুনেছি লম্বালাঠি কামার।"
-"আমার নামই লম্বালাঠি কামার," এই বলে লম্বালাঠি তার লাঠিটিকে একটু খেলিয়ে নিল। "তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। তুমি আমার বন্ধু হবে? আমি দুনিয়া ঘুরে দেখতে যাচ্ছি, তুমি যাবে? আমরা দুজনে মিলে গল্পগাছা করে ভালো সময় কাটাবো।"
পানু গুছাইত রাজী হয়ে গেলো। দুইজনে মিলে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন। তারপর একদিন এক জায়গায় এসে দেখতে পেল তাদেরই বয়সি এক ছেলে বড়বড় পাথর তুলে পাশে সরিয়ে রাখছে, ঠিক যেন রাস্তা থেকে নুড়ি কুড়োচ্ছে। "তোমার নাম কি ভাই?" লম্বালাঠি জিজ্ঞাসা করল।
-"আমার নাম প্রস্তর ধর। আমি ছোটবেলা থেকেই খুব শক্তিশালী। পাথরটাথর নিয়ে খেলতাম তাই আমার এইরকম নাম রাখা হয়েছিলো। অবশ্য আমি শুনেছি আরেকজন আমার থেকেও বেশী শক্তিশালী আছে, তার নাম লম্বালাঠি কামার।"
-"আমিই সেই লম্বালাঠি কামার। আর এ আমার বন্ধু পানু গুছাইত। তুমিও আমাদের সাথে দুনিয়া দেখতে শুরু কর না বাপু। তাহলে আমরা তিনজনে মিলে মজা করব।" প্রস্তর সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলো।
তারা একসাথে দেশবিদেশে ঘুরতে শুরু করলো। তাদের তিনজনেরই অনেক শক্তি ছিলো তাই রাস্তার কোনো অসুবিধা তাদের টলাতে পারেনি।

একদিন তারা এক নদীর ধারে বসে ছিলো। সেখানে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলো। দুটি পরমাসুন্দরী কন্যা নদীতে স্নান করে উঠে দুটি কাঁচের বল নিয়ে খেলা করছে। তারা বলগুলো হাওয়ায় ছুঁড়ছে আবার লুফে নিচ্ছে। দুইজনের মধ্যে যে একটু বড়, তাকে দেখে তো লম্বালাঠি মুগ্ধ হয়ে গেল। কি অপুর্ব রূপসী সে। আর থাকতে না পেরে বন্ধুদের সে বলল “আমি একটু আলাপ করে আসি।” বলেই এক দৌড়ে মেয়েদুটির পিছনে চলে গেল সে। দুটো বলই লুফে নিলো, যদি এই সুযোগে একটু কথা বলা যায়। কিন্তু বল লুফে নিতেই কন্যেদুটি হাওয়া হয়ে গেলো, একদম ভ্যানিস। বাতাস তাদের খেয়ে নিলো না মাটির ভেতরে চলে গেলো লম্বালাঠি কিছুই বুঝতে পারল না। একা একা বোকার মত নদীর ধারে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বন্ধুদের কাছে চলে গিয়ে সে বলল, “তাজ্জব ব্যাপার।“
কিছুদুরে একটা ফাঁকা কুঁড়েঘর ছিল। তাতে কেউ থাকে বলে মনে হলো না, তবে সেখানে তিনটে বিছানা ছিলো আর সুসজ্জিত রান্নাঘর ছিলো। অন্যান্য আসবাবপত্রও যথাযথ ছিলো।
লম্বালাঠি বলল, “আমার বাড়িটা বেশ লেগেছে, এখানেই থাকব আমরা। আমি একটু বিশ্রাম নিই, তোমরা শিকার করে এসো। আমি রাতের খাবার রান্না করে রাখব তোমাদের জন্য।” সেইমতো পানু আর প্রস্তর শিকার করতে গেলো। একটু বিশ্রাম নিয়ে লম্বালাঠি খুব যত্ন করে রাতের খাবার বানালো। রান্নার শেষের দিকে সে গোলমরিচ গুঁড়ো নিতে উল্টোদিকে ফিরেছে, তারপরেই ঘুরে দেখে রান্নাকরা খাবারদাবার সব উধাও। টেবিলের নীচে এক লালবুটপরা বামন খাবার নিয়ে মাটি ফুঁড়ে ঢুকে যাচ্ছে। তার ঠিক পরেই পানু আর প্রস্তর ফিরে এলো, তারা শিকার করে কয়েকটা খরগোশ নিয়ে এসেছে।
“আমার পেটে আগুন জ্বলছে’, এসেই ঘোষণা করল পানু। “কই কই খাবার কই?”
খালি পাত্র আর নিভে যাওয়া আগুন দেখে তারা থমকে দাঁড়ালো।
লম্বালাঠি সবকথা তাদের খুলে বলল, তবে তারা খুব একটা বিশ্বাস করল বলে মনে হল না।
প্রস্তরের এমনিতেই মাথা গরম, সে বলল, “তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে, তারপর তোমার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছিল বলে তুমি সব খেয়ে ফেলেছ, আমাদের জন্য একটুও রাখোনি।”
‘যদি তোমরা আমার কথা বিশ্বাসই না করো, তাহলে কাল আমি আর প্রস্তর বেরোবো, পানু এখানে থেকে খরগোশ রান্না করুক। তাহলে হয়তো বিশ্বাস হবে তোমাদের।”
সেইরকমই কথা হল, সেই রাতে সবাই শুকনো বিস্কুট চিবিয়ে কাটিয়ে দিলো। পরদিন সকালে প্রস্তর আর লম্বালাঠি শিকার করতে বার হল। পানু থেকে গেলো। বেচারা পানু কষে খরগোশের ঝোল রেঁধেছিল। এত ভালো হয়েছিলো রাঁধতে রাঁধতে তার নিজের জিভেই জল চলে আসছিল প্রায়। কিন্তু রান্না শেষ হতেই লালবুট পরা এক বামন এসে তার ঝোলের কড়াই নিয়ে চোখের নিমেষে টেবিলের নীচে দিয়ে মাটির গভীরে চলে গেলো।পানু তার লম্বা হাত বাড়িয়েও তাকে ধরতে পারলো না।
একটু পরেই প্রস্তর আর লম্বালাঠি ফিরে এলো। পানু সবকিছু বলে লম্বালাঠিকে বলল, “আমি তোমাকে অবিশ্বাস করে অন্যায় করেছি, আমাকে ক্ষমা করে দিও ভাই।”
কিন্তু প্রস্তর তখনও বিশ্বাস করল না। দুবেলা ধরে শুকনো পাউরুটি আর বিস্কুট চিবিয়ে এমনিতেই তার মেজাজ গরম ছিলো। সে বলল, “আমি জানি কি হয়েছে, তুমি আর লম্বালাঠি দুইজনে মিলে ষড় করে আমার খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছ। নিশ্চয়ই তোমার খুব খিদে পেয়েছিলো তাই তুমি পুরো ঝোল খেয়ে ফেলেছ।”
লম্বালাঠি আর পানু চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর লম্বালাঠি বলল, “আমি আর পানু বেরোচ্ছি এবার। তুমি এবারের শিকার করে আনা খরগোশের হাঁড়ি কাবাব বানাও দেখি।”
সেইমতো প্রস্তর বাড়িতে থাকলো আর পানু আর লম্বালাঠি শিকার করতে গেলো। এমনিতেই শুকনো বিস্কুট চিবিয়ে প্রস্তরের মাথা খারাপ হয়ে ছিল, তাই আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সে এইসা হাঁড়িকাবাব রাঁধল না! গন্ধে কুঁড়েঘর কেন, পুরো জঙ্গল ম ম করতে থাকল। কিন্তু কপাল তার। রান্না শেষ করে সে যখন টেবিলের উপর ঠান্ডা করতে রেখেছে, লাল বুট পরা বামন টেবিলের তলা থেকে লাফিয়ে উঠে এলো এবং চোখের নিমেষে খাবার নিয়ে হাওয়া হয়ে গেলো।
লম্বালাঠি আর পানু বাড়ি ফিরলে প্রস্তর খুবই দুঃখিত হয়ে বারবার ক্ষমা চাইলো তাদের থেকে। অকারণে সন্দেহ করে অন্যায় করেছে সে। কিন্তু এভাবে প্রত্যেকবার খাবার চুরি হলে এই সুন্দর কুটিরে থাকা যাবে কি করে?
লম্বালাঠি বলল, “আমরা সবথেকে শক্তিশালী তিনজন, আর আমাদেরই বারবার খাবার চুরি করছে হতভাগা বামন? এর একটা বিহিত করতেই হবে, কোথা থেকে সেই বামন আসছে আমাদের জানতে হবে। চল টেবিলের তলার মেঝে খুঁড়ে দেখি।”
যেই বলা সেই কাজ, পানু আর প্রস্তর দুজনেই টেবিলের তলার মাটি খুঁড়তে লাগলো। আর লম্বালাঠি একটা লম্বা মই বানালো এই সময়ে। একটা কুয়োর মত গভীর যখন হয়েছে। তখন লম্বালাঠি বলল, “এবার নীচে গিয়ে দেখতে পারি।” বাকী বন্ধুরাও রাজী হল।
মই দিয়ে নিচে নেমে গেলো লম্বালাঠি। মই যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একটা ভারী দরজা। বন্ধ দেখে সে জোরে করাঘাত করল।
-”কে?”
-”আমি লম্বালাঠি কামার।”
-”এখুনি এখান থেকে পালিয়ে যাও, এটা সাতমাথাওলা ড্রাগনের ঘর। সে যদি দেখতে পায় তোমাকে তাহলে এমন যাদু করবে তুমি আর কখনো বাড়ি ফিরতে পারবে না।”
-”আমি এই ড্রাগন বাহাদুরের সাথে একটু আলাপ আলোচনা করতে চাই।”
দরজা খুলে গেলো। তারপরেই একটা সরসরে শব্দ আর ড্রাগন সাতখানা মাথা নিয়ে হুঙ্কার দিয়ে তেড়ে এলো।
দমাস করে লাঠি চালালো লম্বালাঠি। ব্যাস সাতটা মাথার তিনটে সেখানেই গুঁড়িয়ে গেলো। ব্যাথায় অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ল ড্রাগন।
ড্রাগনের রক্তের ফোঁটা মেঝেতে পড়তেই দেখা গেলো সেই দুই সুন্দরী কন্যার বড়জনকে। ড্রাগনের যাদুতে অদৃশ্য হয়ে ছিলো সে।
কাঁচের বলদুটি পকেট থেকে বের করলো লম্বালাঠি। “চিনতে পারছ এগুলো?”
-”হ্যাঁ! চিনতে পারব না কেন? একটি বল আমার, একটি আমার বোনের। আমি এইদেশের রাজকন্যা।”
লম্বালাঠি তাকে বলদুটি দিয়ে দিলো। “চলুন আমি আপনাকে নিয়ে আপনার বাবার কাছে নিয়ে যাই।”
-”কিন্তু আমার বোন, তাকেও তো জাদু করা হয়েছে। সে আঁটকে আছে পরের দরজার পিছনে। এক লাল টুপি পরা বামন তাকে আঁটকে রেখেছে।”
-”সেই বামনকে খুজতেই তো আমি এখানে এসেছি। আপনাকে তাহলে আমার বন্ধুদের হেপাজতে রেখে আমি আপনার বোনকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি।”
রাজকন্যা কি মনে করে কাঁচের বলদুটি লম্বালাঠিকে ফেরত দিয়ে দিলো। “আপনি এইদুটি রাখুন। যদিও কাঁচের বলদুটিতেও যাদু করা আছে। আপনার কাছে থাকলে আমি আর আমার বোন কথা বলতে পারব না। তবে আমার মন বলছে এইদুটি বল আপনার কাছে থাকাই শ্রেয়।”
বলদুটি পকেটে ভরে বড়রাজকন্যাকে এক হাতে তুলে নিয়ে মই বেয়ে উঠতে শুরু করল লম্বালাঠি।
বন্ধুরা তো এক সুন্দরীকে দেখে অবাক। লম্বালাঠি তাদের বলল, “ইনি এদেশের রাজকন্যা। ওঁর বোনও আঁটকে আছে, তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি, তারপর রাজামশাইয়ের কাছে এঁদের নিয়ে যাবো। না জানি উনি কত দুঃখ পাচ্ছেন এঁদের হারিয়ে।”
এই বলে লম্বালাঠি আবার মই বেয়ে নীচে নামল, ড্রাগন তখনো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তাকে পেরিয়ে আরেকটু দুরেই আরেক বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে।
বন্ধ দেখে সে জোরে করাঘাত করল।
-”কে?’
-”আমি লম্বালাঠি কামার।”
-”এখুনি এখান থেকে পালিয়ে যাও, এটা লালবুটপরা বামনের বাড়ি। সে যদি দেখতে পায় তোমাকে তাহলে এমন যাদু করবে তুমি আর কখনো বাড়ি ফিরতে পারবে না।”
-”আরে! লালবুট পরা বামনের খোঁজই তো আমি করছি। “
দরজা খুলে গেলো।
লম্বালাঠি ঘরে ঢুকে দেখলো, সেখানে একটা সাদা আর আরেকটা কালো তলোয়ার রাখা।
এক মুহুর্তের মধ্যেই লালবুট পরা বামুন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। সে বললো, “এসো যুদ্ধ করে দেখি কে বেশি শক্তিশালী আর চটপটে। লাঠি ছাড়ো আমি সাদা তলোয়ার নিয়ে লড়ি আর তুমি কালো।”
লম্বালাঠি বলল, “আইডিয়া মন্দ নয়, তবে সাদা তলোয়ার নিয়ে আমি লড়ব।”
-’বেশ, তাই হোক। “
লাল বুট পরা বামন খুবই চটপটে তাতে সন্দেহ নেই। তবে শক্তিতে লম্বালাঠির সাথে পেরে ওঠা কঠিন। একটু পরেই বামন ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সাদা তলোয়ারের এক খোঁচায় বামনের হাতে কেটে গেলো। অজ্ঞান হয়ে গেলো সে। তার রক্ত মাটিতে পড়তেই ছোট রাজকুমারীও যাদুমুক্ত হল। সেও একনজরে তার বল চিনতে পারলো, তারপর বলটি আবার লম্বালাঠিকে ফেরতও দিয়ে দিলো।
লম্বালাঠি তার হাত ধরে মই বেয়ে উপরে উঠে এলো। উপরে এসেই তার মনে পড়ল সে তার লাঠিখানা নীচে ফেলে এসেছে। সে বন্ধুদের বলল “একটু অপেক্ষা কর, আমি লাঠি নিয়ে আসছি আবার। তারপর সবার রাজপ্রাসাদে যাব।”
এই বলে সে নীচে নামল আবার। কিন্তু সুন্দরী রাজকন্যাদের দেখে পানু আর প্রস্তরের মাথা খারাপ হয়ে গেছে ততক্ষনে। তারা দেখল রাজকন্যারা কেউ কথা বলছেন না। নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করল তারা, সবকিছুই তো লম্বালাঠি করেছে, আমরা তো কিছুই পাবোনা রাজপ্রাসাদে। তার থেকে আমরাই আগে রাজকন্যাদের নিয়ে প্রাসাদে চলে যাই। এঁরা কথা বলছেন না, তাই লম্বালাঠির কথাও কিছুই বলতে পারবেন না। আমরা অনেক পুরষ্কার পাব সেই সুযোগে।
লম্বালাঠির মই উঠিয়ে নিলো তারা। থাকুক ব্যাটা নিচে। রাজকন্যাদের নিয়ে রওয়ানা দিলো রাজপ্রাসাদের দিকে।
লম্বালাঠি নীচের দুই নম্বর ঘরে গিয়ে দেখে সেখানেই লাঠিটা পড়ে রয়েছে। ড্রাগন অজ্ঞান অবস্থাতেই মারা গেছে। আর লাল বুট পরা বামন তখনো অজ্ঞান। সে লাঠি নিয়ে এলো মইয়ের কাছে। কিন্তু একি? মই নেই, তুলে নেওয়া হয়েছে। চিৎকার করে বন্ধুদের ডাকল সে অনেকবার, কিন্তু কোনো সাড়া পেলো না। হতাশ হয়ে বসে পড়ল সে, খানিকক্ষণ পরে সে ভেবে দেখল আরে, ওই লালবুটপরা বামন তো জমিতে উঠতে পারে।
লালবুটপরা বামনের জ্ঞান ফিরেছে ততক্ষণে। সে সাদা তলোয়ারটা নিয়ে আবার যুদ্ধ করতে চাইছে। এমন সময় তাকে লম্বালাঠি বলল, “তুমি হেরে গেছ, তার মানে তুমি আমার বন্দী। যদি আমাকে একটু সাহায্য কর তাহলে এই বন্দীদশা থেকে তুমি মুক্তি পেতে পারো, তবে তার আগে তোমাকে কথা দিতে হবে আর কাউকে তুমি বন্দী বানাবে না।” লালবুট বামন আর কি করে, সে কথা দিলো যে আর কাউকে সে বন্দী বানাবে না। “কি করতে হবে এবার?” সে লম্বালাঠিকে জিজ্ঞাসা করল।
-”আমাকে গর্ত থেকে বার করে নদীর ধারে পৌঁছে দিতেহবে।”
-”ও এইটুকু কাজ, এ তো সোজা, এসো আমার হাত ধর।” বামন বলল
লম্বালাঠি আগে সাদা তলোয়ারকে কোমরে গুঁজল তারপর বাঁ হাতে লাঠি নিয়ে ডানহাতে শক্ত করে বামনের হাত ধরল।
এক নিমেষে সে পৌঁছে গেল নদীর ধারে। তারপর বামনকে বলল, “এবার তুমি মুক্ত, নিজের প্রতিজ্ঞা মনে রাখবে।” পরমুহুর্তেই বামন হাওয়া হয়ে গেলো।
লম্বালাঠি পৌছলো রাজপ্রাসাদে, দেখল হারিয়ে যাওয়া রাজকন্যাদের পেয়ে সেখানে উৎসব শুরু হয়েছে। কিন্তু কেন রাজকন্যারা কেউ কথা বলছেন না, সেটা নিয়ে রাজামশাই একটু চিন্তিত।
পানু আর প্রস্তরকে কি পুরষ্কার দেওয়া হবে সেই বিষয়েও জোর আলোচনা চলছে।
ইতিমধ্যে লম্বালাঠি একেবারে দরবারে পৌঁছে গেছে। তার রাগী চোখ দেখে পানু আর প্রস্তর ভয় পেয়ে সেই যে দৌড় দিলো, তাদের আর সেই দেশের ত্রিসিমানায় দেখা গেলো না।
সে পকেট থেকে কাঁচের বলদুটি বের করে রাজকন্যাদের দিতেই তারা ঝর্ণার মত কলকল করে কথা বলতে লাগল। আসলে কি হয়েছে সব গল্পই তারা রাজামশাইকে করল।
রাজা লম্বালাঠির উপর খুবই প্রসন্ন হলেন। “আমি স্থির করেছি আমার একটি কন্যার সাথে তোমার বিবাহ দেবো। তুমি কাকে বিয়ে করতে চাও?”
লম্বালাঠির তো আগেই বড়রাজকন্যাকে খুব পছন্দ ছিলো, সে সেটাই জানালো।
তারপর তো ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেলো। লম্বালাঠি তার বাবা কামার আর মা কেও মহলে নিয়ে এলো। রাজামশাই যথাসময়ে চোখ বুজলে লম্বালাঠিই রাজা হলো।
সমাপ্ত

[এইরকমই একটা গল্প, গড়ানে মটর আমি ইউক্রেনের লোককথায় পড়েছি। তাই কোথাকার এই গল্পটি সেটা নিয়ে একটা সন্দেহ ছিলো। তারপর একটু খোঁজাখুঁজি করতে গুগলা বলল এটি পোর্তুগীজ লোককথা।]

Comments

  1. অনন্য উপকথার গল্প ।
    ভালো লাগলো ।

    ReplyDelete

Post a Comment