পোস্টমর্টেম (সত্য ঘটনা অনুসারে)

আমাদের বাড়ির তিনতলায় একটা সিড়ির ল্যান্ডিংএর ঘর আছে। বাড়ির সবথেকে উপরের ঘর। বাবা যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন সেই ঘরে বাবার একছত্র সাম্রাজ্য ছিল। ঘরটায় একটা চার বাই ছয় খাট, আর একটা বুককেস ছিল। আর উপচীয়মান বই, ইস্কুলের খাতা, খবরের কাগজ আর লাখখানেক সিগারেটের ল্যাজ। ছুটির দিন সারাদিন আর অন্যান্যদিনের সকালে ও সন্ধ্যায় বাবা ওই ঘরেই থাকতেন। সকালে তিনখানা কাগজ মুখস্থ করতেন, তারপর খাতা দেখতেন, আর দুটো খাতা দেখার পরই কোনো একটা গল্পের বইতে মজে যেতেন। ওই ঘরটার উপর বাড়ির সব্বার লোভ ছিল। যেমন হাওয়া, তেমনি প্রাইভেসি। নিজের একটা ডেন কে না চায়?
সালটা সম্ভবত দুহাজার তিন বা চার। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে, কলেজে পড়ছি। পুজোর ছুটিতে বাড়িতে বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন বেড়াতে এসেছেন। বাবার ব্রেইন টিউমর থাকায়, বাবাকে একা শুতে দেওয়া হত না কোনমতেই, কাজেই বাবার প্রবল অনিচ্ছাসত্বেও দুইতিন দিনের জন্য ওই টংএর ঘরে আমার শোয়ার ব্যবস্থা করা হল। পইপই করে বলে দিলেন কোনো জিনিসে হাত দেওয়া চলবে না। শুনেই তো বুঝে গেছি নিশ্চয়ই এমন কিছু একটা লোভনীয় জিনিস ওখানে আছে, যেটার জন্য বাবার এত স্পেশাল দুশ্চিন্তা।
রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর শুতে গেলাম, বাবা নিজে এসে দেখে গেলেন মশারী টাঙ্গিয়েছি কি না। (কুঁড়েমির বদনাম আমার চিরকালের) বাবা নীচে নামতেই আমার তদন্ত শুরু হল। দেখি বুককেসের মাথায়, একরাশ খবরের কাগজ আর ইস্কুলের খাতার মাঝে আছে সেই গুপ্তধন। একটা বই, নাম হল পোস্টমর্টেম (সত্য ঘটনা অবলম্বনে) লেখকের নাম ভুলে গেছি, কোনো এক প্রাক্তন ইন্সপেকটর। বই খুলেই দেখি বাবার স্কুল লাইব্রেরীর ছাপ মারা।
গুপ্তধন বলার কারণ হল, আমাদের বাড়ির প্রত্যেকটা লোক রহস্যরোমাঞ্চ কাহিনীর সাঙ্ঘাতিক টাইপের পোকা। রহস্যরোমাঞ্চের কোনো বই বাড়িতে নিয়ে এসে যদি ঠিকভাবে লুকিয়ে না রাখা যায়, তাহলে সেটা হাপিস হয়ে যাবে, পরের দিন দেখতে পাবেন মা বা দিদা বা বাবা দখল করে ফেলেছে। কাজেই বুঝে গেলাম, এই সাংঘাতিক বইটা বাবা আগে পড়ে ফেলতে চেয়েছেন। কাজেই তুরুপ মেরে দিয়েছি।
ঘুমটুম চুলোয় যাক, আজ রাত্রেই এটা ফিনিশ করতে হবে, হাতে মাত্র দুইরাত আছে। আলোটালো জ্বেলে শুরু হয়ে গেলাম। বইটার মূল বিষয় হল, কত আজেবাজে ভাবে লাশ পাওয়া যাচ্ছে, আর সাংঘাতিক এক্সপার্ট ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট এর ডাক্তার এবং পুলিশ অফিসারের জুটি ঠিক ধরে ফেলছেন কে খুনি। এই নিয়ে প্রায় গোটা দশ বারো বড়বড় গল্প। আজকে বুঝতে পারি বাবা কেন চাইতেন না ওই বইটা পড়ি, কারণ বইটাতে অত্যধিক রকমের ভায়োলেন্স ছিল। ফেলুদা বা ব্যোমকেশ সেখানে সুগন্ধি তিন নং পরিমল নস্যি।
সেই গল্পটার শুরুটা আজও মনে আছে, একজন মহিলার টুকরো টুকরো করে কাটা লাশ পাওয়া গেছে শহরের উনত্রিশটা ডাস্টবিনে। সেইগুলো জোগাড় করে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ খোঁজ করার চেষ্টা করছেন কে এই মহিলা আর হত্যাকারীই বা কে? পড়তে পড়তে তো আমার গায়ের প্রত্যেকটা লোম খাড়া, চুলগুলোও খাড়া হওয়ার জোগাড়। গল্পের শেষে পুলিশ ধাওয়া করেছে আততায়ীকে, আততায়ী এসে লুকিয়ে আছে, খাটের নীচে এক গোপন কুঠুরীঘরে। ইন্সপেক্টর ঘরে ঢুকে অবাক, কেউ নেই ঘরে... আততায়ী বন্দুক তাক করেছে খাটের তলা থেকে, ব্যাস...
বুদুম ফট্টাসস!!!!!! দুম করে কারেন্ট চলে গেল, আর প্রায় সাথে সাথেই চারদিক আলো করে বিশাল জোরে একটা বাজ পড়ল কাছেই কোথাও। এইবার কেস হল, বাজের শব্দে আমি ছোটবেলা থেকেই খুব ভয় পাই। তার উপরে একদম উপরের ঘরে শুয়েছি, বাজ আমার জন্যেই পড়ছে এ বিষয়ে আমি দৃঢ় নিশ্চিত। কেন মরতে মানা করা সত্বেও ওই বই পড়তে গেলাম। চারদিকে বেশ জোরে ঝড় হচ্ছে, বৃষ্টিও শুরু হল, জানলাগুলো বন্ধ করা উচিত, কিন্তু করব কি করে, করতে গেলেই খাট থেকে নামতে হবে, আর খাটের তলাতেই তো সেই আততায়ী বন্দুক নিয়ে অপেক্ষা করছে। যদি পা ধরে টানে?
ঘরটা নিতান্তই ছোট ছিল, খাট থেকে দরজায় হাত পাওয়া যায়। টুক করে দরজাটা খুলে ফেললাম, তারপর খাট থেকে সোজা সিঁড়িতে একটা লম্বা লাফ। সেখান থেকে শুকনো গলায় ও ব্যাবা গো করে একটা ডাক দিলাম, কিন্তু কেউ সাড়া দিলো না। ব্যাস, খুনী নিশ্চয়ই সব্বাইকে কেটে রেখে গেছে নীচে। দুমদাম করে নীচে চলে এসে দেখি সব্বাই অকাতরে ঘুমোচ্ছে। বাইরেটা ঠান্ডা বলে ফ্যান না চলাতেও কারোর অসুবিধা হচ্ছে না। বাড়ির লোকেদের জ্যান্ত দেখে নিশ্চিন্ত হলাম, যে আমিও এক্ষুনি মারা যাচ্ছি না। দিদার ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে খানিকখন বৃষ্টি দেখলাম। ( বাজপড়াকে ভয় পেলেও ঝড়বৃষ্টি আমার দারুণ লাগে)। বাবার ড্রয়ার থেকে টর্চটা নিয়ে, চোখেমুখে জল দিয়ে, আস্তে আস্তে আবার উঠে গেলাম আমার ঘরে।
সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে টর্চ মেরে দেখে নিলাম খাটের তলায় কেউ নেই, ব্যাস, আদ্ধেক সাহস সেখানেই ফিরে পেয়েছি, তবু রিস্ক না নিয়ে দরজার সামনে থেকে আরেক লম্বা লাফে খাটে উঠে গেলাম। খাট থেকেই দুটো জানলা বন্ধ করলাম, একটায় হাত পেলামনা বলে বাদ থাকল।
এবার শুয়ে পড়লাম, কিন্তু তাহলে কি হবে, ঘুমোতে হবে তো, বালিশের তলায় সেই বই। যতবার চোখ বুজি, দেখি উনত্রিশ টুকরো লাশ ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে।
ভগবানে বিশ্বাস টা ফ্যামিলিগতভাবে নেই, যে ডেকে পার পাবো। আমি কিন্তু ভুতের ভয় পাইনা, ছোটবেলা থেকে রহস্য রোমাঞ্চ পড়ে পড়ে, আমার যাবতীয় ভয় হল পাগল আর খুনীর। পাগল খুনী তো আরো মারাত্মক। কাজেই রবীন্দ্রনাথ ভরসা। আর কোনো ঠাকুরকে বাবা বিশ্বাস করতেন না।কাজেই শেষে গুরুদেবের শরণাপন্ন হতে হল।
ভয় হতে তব অভয় মাঝে নুতন জনম দাও হে... বেশ জোরে জোরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে শুরু করলাম, তারপর স্কুলে শেখা সবকটা প্রেয়ারের গান ( সবই রবীন্দ্রসঙ্গীত)। খানিক পরে, বাইরে ঝড় একটু কমল, বুক ঢিপঢিপও কমল, কখন জানি ঘুমিয়েও পড়লাম।
(বাবা থাকা কালীন এই গল্পটা করা হয়নি, কারণ তাহলে ওই মাঝে মাঝে তিনতলার টং এর ঘরে ঘুমোনোটা বন্ধ হয়ে যেত। পরে অফিসে চাকরি করাকালীন প্রায় তিনচারমাস ওখানে শুয়েছি, বাবা তখন খুবই অসুস্থ, তিনতলায় যাওয়া বন্ধ। কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পর, ওই ঘরের মোহ অনেক কমে গেছে, কেউ বকাঝকা, হাজার আপত্তি না করলে কি আর সেই জিনিসের লোভ থাকে?)
বইটা কিন্তু হেব্বি ছিল। পরেরদিন শেষ করে ফেলেছিলাম, আর ভয় পাইনি।

Comments

Post a Comment