বোস্টিং পোস্টিং

বোস্টিং পোস্টিং
~~~~~~~~~~~~~~~~
যদিও নামটা গুরুর থেকেই ধার করা, তবুও টপিক কিন্তু সামান্য হলেও আলাদা। আমার বোস্টিং পোস্টিং এ বোস্টিং তো আছেই, তার সাথে আছে একটা অন্যরকম পুরোনো গল্প আর অনেকটা অহঙ্কার আর বন্ধুগর্বে গর্বিত হওয়া।
গল্পের শুরু সম্ভবত ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারী। তখনকার এক বিখ্যাত বাংলা অনলাইন ফোরামে গিয়েছিলাম একটা বাংলা সিনেমার খোঁজে। সেখানে গিয়ে দেখতে পেলাম একটা গ্রুপ চ্যাটের উইন্ডো। আর সেখানে সন্ধ্যাবেলায় চলছে দেদার আড্ডা। সে আড্ডার বিষয়বস্তু আর ভাষা দুইই অসাধারণ। এমনিতেই আমাকে দুটো জিনিস সাঙ্ঘাতিক আকর্ষণ করে, সেন্স অফ হিউমর আর ভাষার খেলা, সেখানে দেখলাম দুইয়েরই প্রাচুর্য। যাই হোক, আমিও আস্তে আস্তে ছুঁচ হয়ে সেই আড্ডায় ঢুকে পড়লাম। সেই আড্ডা থেকেই প্রথম আলাপ গুরুর সাথে। তখন কিন্তু গুরু বলে ডাকতাম না। ব্যান্ড দা বলে ডাকতাম। তিনি শিং বলে ডাকতেন।

পুজোর পর এক মিটিং ঠিক হল, আড্ডার সকলেই আসবেন, আমিও গুটিগুটি পায়ে হাজির হলাম সেখানে, সেখানেই আলাপ হল বললে ভুল হবে, সেখানে আমার বহুচেনা মানুষগুলোকে একটা করে মুখ দিতে পারলাম। আর ব্যান্ডদাকে দেখে তো হাঁ, এই সাঙ্ঘাতিক রকমের হ্যান্ডু লোকটা ভাগ্যিস আগে থেকেই আমার বন্ধু, না হলে তো বিন্দুমাত্র পাত্তা পেতাম না।
সেই অনলাইন ফোরামেই শুরু হয়েছিল গুরুর লেখা। প্রথমেই অ্যাটিনা। তারপর আমার প্রেম দুইখন্ডে। তখন প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যাবেলায় গুরুর একটা লেখা আসবেই ফোরামের শিল্পী সাহিত্যিকের কর্ণারে। কিন্তু সে আর কদিন। গোটা তিনচারেকের পরেই তিনি শুরু করলেন ইন্দ্রজাল কমিক্স উদ্ধার করার কাজ। এগারোর জানুয়ারী থেকে টোট্যালি বেপাত্তা। কি আর করা, ফোনে ধরে বেঁধে জিজ্ঞাসা করা, "আমিও একটু ইন্দ্রজাল কমিক্স উদ্ধার করব"? মনের মধ্যে আসলি ইচ্ছেটা হল, তাহলে কাজটা ভাগ হয়ে যাবে, আর তুমিও আরএকটু লিখবে। তা তিনি বললেন, "নাহ, তুমি করবে অমরচিত্রকথা উদ্ধার"। হাতে ধরে শেখালেন স্ক্যান আর এডিট করা। তার মধ্যে অবশ্য আবিষ্কার হয়েছে, আমরা দুইজনেই মুভিবাফ। কাজেই শুরু হল সিনেমা দেখা, প্রায় প্রতি সপ্তাহে। তিনি শেখালেন সিনেমা দেখতে। বই পড়তেও শেখালেন। মানে এই দুটো তো ছোটবেলা থেকেই পারি, কিন্তু তিনি শেখালেন, সিনেমার সাথে চিত্রনাট্য , পরিচালনা, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল হ্যানতেন দেখতে হয়, আর বই পড়ার সময় লেখকের ভাষার ব্যবহার, বইয়ের কাগজ থেকে শুরু করে মুদ্রণ , অলঙ্করণ সবকিছুকে দেখা। মানে শুধুই ক্যাবলার মত দেখা বা পড়া না। এবার বলুন দেখি দাদাদিদিগণ একে গুরু বলব না তো কাকে বলব? অবশ্য আমিও তখন শিং হয়ে মাথায় চেপে বসেছি।
এরপর শুরু হল আসলি ম্যাজিক, একদিন খবর পেলাম আমার প্রেম উনিশ কুড়ি ম্যাগাজিনের জন্য সিলেক্ট হয়েছে। আনন্দে আটখানা হয়ে গেলাম। আমার গুরুর প্রথম গল্পই প্রথম প্রচেষ্টাতেই উনিশ কুড়িতে বেরোবে। সেই সময় থেকেই শুরু হয় আমার প্রথম পাঠিকা হওয়ার সফর। প্রতিটা গল্প আসে আমার ইমেইলএ, তারপর সেটাকে আমি বার চারেক পড়ি, তারপর মতামত দি, অবশ্যই একজন পাঠকের দৃষ্টি থেকে। "জলযাপনের দিনগুলি" এই গল্পটার প্রথম নাম ছিল স্যান্ট্যার‍্যান। এই গল্পটা নিয়ে হেব্বি ইমেইল চালাচালি হয়েছিল মনে আছে। তারপর থেকে প্রতি সপ্তাহে ঘ্যানঘ্যান, প্রতি মাসে আরো বেশি ঘ্যানঘ্যান, ও গুরু গপ্পো কই। প্রতি জন্মদিনের আগে একবার করে রিমাইন্ডার, কারণ আমার গুরু আমাকে প্রতি জন্মদিনে একটা করে গপ্পো উপহার দেন ( কলার উঁচু)।
দীপান্বিতা গল্পটা বেশ তাড়াহুড়ো করে লেখা হয়েছিল মনে আছে। কিন্তু পড়ে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। গুরুর লেখার মান যেন এক ধাক্কায় অনেকটা উপরে উঠে গেছিল, তারপর যেদিন দেশ পত্রিকার জন্য সেটা সিলেক্ট হল, সেদিন আমি অফিসে, আর গুরু ফোন করেছে বলে করিডরে বেরিয়ে ফোন ধরেছি। সেই মুহুর্ত আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। ফোনের দুইদিকে দুইজন হাউমাউ করে কাঁদছি। আর সেইদিন বলেছিলাম, বইমেলায় তোমার বই বেরোবো দেখো, নিশ্চয়ি বেরোবে।
বিভা প্রকাশনীর এপার বাংলা ওপার বাংলা বইতে প্রথম গুরুর দুটো গল্প বেরোলো। বইমেলায় সেই বই কিনতে গিয়ে আরো এক রাউন্ড কেঁদে ভাসালাম।
রস রহস্যের সাতকাহন বইটা আমার নিজস্ব অহঙ্কার, কারণ এই বইটা গুরু আমাকে দিয়েছে, মানে উৎসর্গ করেছে। তাই নিয়ে আবার একটা চাকরির ইন্টারভিউতে এত ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গল্প করে এলাম, যে চাকরিটা হল না, কিন্তু ইন্টারভিউ বোর্ডের সব্বাই মানতে বাধ্য হলেন যে এটা গ্রেটেস্ট গিফট। :P , বইমেলায় বইটার বিক্কিরি কম হয়েছিল, তার জন্য নিজেকেও খানিকটা দায়ী করি, আমার নামটাই অপয়া। সর্বদা ব্যাগে নিয়ে ঘুরে বেড়াই সেই বই আজও। বোস্টিং এর এমন সুযোগ ছাড়া যায়?
এরপর গুরু হেব্বি বিজি হয়ে লেখাটেখা থামিয়ে দিয়ে শুধু বইয়ের সমালোচনা লিখতে লাগল, আর আমিও বিয়েথা করে ( কত্তাও ওই অনলাইন ফোরাম থেকেই জোগাড় হয়েছেন) , হায়দ্রাবাদে গিয়ে চাকরি করতে লাগলাম। এবার ব্যস্ততার কারণ জানা থাকায় চাপ দিতেও খারাপ লাগে। আবার চাপ না দিলে আমার প্রাণের আরাম হয়নে। লেখা পাওয়া যায় না। আর হায়দ্রাবাদে আমার চাকরির যা ছিরি ছিল, সারাদিন ঘুমু করতাম, আর রাতে আপিস। নিয়মিত ফোন করাও হয় না। আর ফোন করলেও গুরুর আর আমার দুজনেরই নেটওয়ার্কের যা অবস্থা, ১০ মিনিট কথা বলা মুশকিল।
ইতিমধ্যে আমি চাকরিতে ইতি দিয়ে কলকাতায় আবার বছরখানেকের জন্য ফিরলাম। রিভিউয়ার্স গ্রুপে একদিন দেখি, গুরুর বই বেরোবে এই বইমেলায়। ভয়ানক অভিমান হল। এই প্রথম, আমি খবর জানছি অন্যের মুখ থেকে। কি জানি বাপু, এর মধ্যে আরো কিছু লিখেটিখে ফেলেছে কি না। সেই দুই তিন মাস আগে একটা গল্প ( সেটা এখনো অপ্রকাশিত) পড়তে দিয়েছিল, তারপর আবার সব ঠান্ডা।
সেই বই আবার জোগাড় হল যখন, তখন ব্যাগে আরো একটা বইয়ের জন্য চিরস্থায়ী বন্দ্যোবস্ত ( বানানভুল ইন্টেন্ডেড) করতে হল।
প্রাণের আরাম আবার হল, পরশু রাতে আবার আরেকটা নতুন গপ্পো পড়লাম। বড় ভালো লেখা। যাক , সব ঠিকঠাক আছে তাহলে। গুরুকে ফুনিয়ে বললাম, "আমি ভাবলাম আর আমাকে গপ্পো পড়তে দিচ্ছ না।" গুরু বললে, " পাগল নাকি, প্রথম পাঠিকাকে না পড়ালে হয়?" মনটা গর্বে আর আনন্দে ভরে গেল।মোদ্দা কথাটা হল, আমি নতুন গল্প পড়তে পাচ্ছি না মানে গুরু লিখছে না। এই আমার বোস্টিং পোস্টিং। 

Comments