হারিয়ে যাওয়া মানুষটি

তখন কলেজে ফার্স্টইয়ারে পড়ি, আর একটা প্রেম করি। প্রথম প্রেম। যাকে করি, সে নাগপুরে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইন্যাল ইয়ার, আমার থেকে বয়সে অনেক বড়, অনলাইন চ্যাটে আলাপ আর ফোনে কথোপকথন, একবারো দেখিনি তাকে তখনও। ২০০৩-০৪ সাল, তখন এক মাসের ভ্যালিডিটি পেতে গেলে হাচ ( এখন যেটা ভোডাফোন) সাড়ে তিনশ টাকা ভরাতে হত, আর কলচার্জ ছিল বিশাল, একশ টাকার টকটাইম পেতাম মাত্র। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে ( মানে না খেয়ে) একদিন অন্তর ফোন করতাম দুপুরে। সে কোনোকালে জিজ্ঞাসাও করেনি, সেই সকালে কলেজে আসো, আর বিকেলে ফেরো, টিফিন করো তো? ছাত্র হওয়ার সুবাদে তার কাছে কখনোই টাকা থাকত না, আর আমার কোথা থেকে টাকা আসবে, সেটা নিয়ে সে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায়নি কোনোকালে। ধমক ছাড়া কথাই বলত না, আর আমি এমন ভেবলি ছিলাম, ওই ধমকটাকেই ভালোবাসা ধরে নিয়েছিলাম। প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম, মনে মনে ভয়ও পেতাম একটু। নাগপুরে থেকে সে কলকাতায় আমার জীবনকে কনট্রোল করত নির্বিবাদে। 
একদিন কলেজের কম্পিউটার ল্যাব থেকে চ্যাট করছি, হঠাৎ একটা চ্যাটহেড জিজ্ঞাসিল, নাম জানাবে? আমি কখনোই আসল নাম ব্যবহার করতাম না, নকল নামটাই দিলাম ঠুকে, শিঞ্জিনী, তোমার? উত্তর এলো, সৌমেন।
মন খুব খারাপ ছিল সেইদিন, একটু আগেই ধমক খেয়ে এসেছি। রাগও হয়েছে, তবে গলা তুলে ঝগড়া করার সাহস ছিল না। তাই প্রথমেই লিখলাম, আমার কিন্তু বয়ফ্রেন্ড আছে। সে বলল, তাতে কি? আমি তো বন্ধু। তোমার কি মন খারাপ? আমার কি যে হল, আমার যত রাগ দুঃখ, ফ্রাস্ট্রেশন, সব লিখে ফেললাম, একটা অচেনা মানুষের কাছে পুরো মন খুলে লিখে লিখে বকবক করে গেলাম প্রায় ঘন্টা খানেক। ততক্ষণে তুমি থেকে তুইতে চলে এসেছি। এবার চলে যাওয়ার সময়। সেই বলল, ফোন নাম্বারটা দিবি? একদম জ্বালাবো না, প্রমিস। কি মনে হল, ফোন নাম্বারটা দিলাম। দিয়ে বললাম, আমি ক্লাসে যাচ্ছি। আবার যেদিন অনলাইন হব, সেইদিন এসএমএস করে দেব। সে বলল, আরে, আমার নাম্বারটা তো নে, না হলে কি করে করবি? বললাম, সময় নেই, তুই মিসড কল দিস।
দুই মিনিট বাদে, ক্লাসে এসে সবে বসেছি, কেমিস্ট্রি ম্যাম তখনও আসেননি, ক্লাসে তুমুল হট্টোগোল চলছে। হঠাত ফোন এলো, অচেনা নাম্বার থেকে।
-হ্যালো
-তুই শিঞ্জিনী তো?
-হ্যাঁ, তুই সৌমেন?
-হ্যাঁ রে, এটা আমার নম্বর। সেভ করিস।
-তোকে তো মিসডকল দিতে বলেছিলাম, ফোন করলি কেন?
-না দেখতে চাইলাম, তুই সত্যিই মেয়ে না ছেলে হয়ে ফেক প্রোফাইল দিয়ে মুরগী করছিস।
হেসে ফেলে বললাম, এবার নিশ্চিন্ত তো, রেখে দে, আমার ক্লাস শুরু হবে।
মাস দুয়েক প্রচুর আড্ডা মারলাম। এত নরম, এত ভালো ছেলে আমি দেখিনি আগে। একদিন হঠাত করে ফোন করা বন্ধ করে দিলো। আমি বহুবার ফোন করলাম, মেসেজ করলাম, কোনো উত্তর নেই। আমার উপর রাগ করেছে কি? না কিছু হয়েছে বিপদ, কিছুই বুঝতে পারলাম না।
অনেক কাঁদলাম রাতে। পরেরদিনও একই রকম। সারাদিন চেষ্টার পর, কোনোমতেই যোগাযোগ করতে না পেরে লাস্টে একটা মেসেজ করে লিখলাম, তোর শরীর ঠিক আছে তো? আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তুই ঠিক থাকলে একবার শুধু হ্যাঁ লিখে পাঠা, আমি আর তোকে জ্বালাবো না প্রমিস।
রাত দুটোর সময় ফোন এলো। ওইপারে একজন সম্পুর্ণ হেরে যাওয়া মানুষ, কান্নামাখা ভাঙা গলায় বলল, "তোকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি রে। তোকে আর ফোন করব না, দেখাও করব না কখনো। তুই খুব ভালো থাকিস"
বজ্রাহত হয়ে বললাম "এটা তুই কি করলি রে, তুই তো জানিস আমার বয়ফ্রেন্ড আছে।"
সে বলল, জানি বলেই তো সরে যাচ্ছি। আমার জন্য তুই আরো কষ্ট পাবি, বা অন্য কাউকে কষ্ট দিবি সেটা আমি হতে দেব না।
মরিয়া হয়ে বললাম, একবার দেখা কর প্লিজ।
সে কিছুতেই রাজী নয়। অনেক বলাতে শেষে রাজী হল, তবে কথা দিলাম দুইজনেই, যে এই শেষ। আর যোগাযোগ করব না।
পরের দিন নন্দনে গিয়ে অপেক্ষা করছি। সে এসএমএস করল, "আমি আসছি না, আমার সাহস নেই তোর সামনে দাঁড়ানোর।"
আমি রিপ্লাই দিলাম, তুই না এলে আমি বাড়ি যাব না, এখানেই অপেক্ষায় থাকব। কোথা থেকে অত দৃঢ়তা পেলাম কে জানে।
দশ মিনিট পর রিপ্লাই এলো, আসছি।
আধঘন্টা পর সে এল। ছিপছিপে তরুণ, মুখে জোর করা হাসি, চোখের দিকে তাকানো যায় না। এত বেদনা।
চুপচাপ দুইজনে বসে রইলাম এক ঘন্টা। কেউ কোনো কথা বললাম না।
একটা চিঠি লিখেছিলাম, যে আমিও বড় ভালোবাসি তাকে। কিন্তু ব্রেকআপ করার সাহস নেই আমার। বেশ লম্বা ছিল চিঠিটা মনে আছে। সেটা তাকে দিয়ে বললাম, "আমি চলে যাওয়ার পর পড়িস।"
সে আমাকে বলল, "নিজেকে কখনো অসুন্দর ভাবিস না। আর কখনো ভাবিসনা যে তোর বর্তমান বয়ফ্রেন্ডকে ছেড়ে তুই আমার কাছে চলে আসবি। তাহলে নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাবি। মনে শান্তি পাবি না।"
কপালে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলল, "এই মেয়ে, আমি যাই, তুই ভালো থাক।"
সেই শেষ কথা, সেই শেষ দেখা, সেই সবথেকে প্রিয় চুমু আজও

Comments