রান্নার গল্প

আমার প্রথম রান্নার গল্প একটা পিকনিকেরও গল্প। আমি চিরকালই ওভার কনফিডেন্ট আমার রান্নার ব্যাপারে। তো এই গল্পের আরো দুইজন পাত্র পাত্রীর নাম অজয় চৌহান এবং সুশান্তা। দুইজনেই আমার বন্ধু ছিল এনআইআইটির। প্রথমজন বাংলা পড়তে পারে না, আর দ্বিতীয়জনকে আমি ফেসবুকে খুঁজে পাইনি, তাই এই গল্পের কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ নেই, তবে অক্ষরে অক্ষরে সচ বাত আছে।

অজয় চৌহান রানীগঞ্জের এক বাড়ির ছোটখোকা এবং সুশান্তার তৎকালীন বয়ফ্রেন্ড। আমার হেবি বন্ধু। সে যাই হোক, অজয় একা একা থাকত, এবং ক্লাস থাকলেই বলত, আজ লৌকিকা সবজী খায়া্‌, আজ করেলে কা সবজী খায়া, আর আমাদের হেবি মায়া লাগত। তাই আমরা ঠিক করলাম একদিন পিকনিক হবে অজয়ের বাড়িতে। সিম্পল মেনু, লুচি, চিকেন আর কোল্ডড্রিংক। আমি বেশি পাকামো করে বললাম আমি চিকেন রাঁধব। এদিকে চিকেন কেন, আমি কিছুই রাঁধিনি তার আগে।


বাড়িতে বললাম নেমন্তন্ন বেহালাতেই, আর মা কে জিজ্ঞাসা করলাম, চিকেন কি করে রাঁধে গো? মা বললেন, আগে চিকেনকে ম্যারিনেট করবে, দই, আদা রসুনবাটা, হলুদ, লংকাগুড়ো সব দিয়ে। তারপর কড়াতে তেল দিয়ে, পেঁয়াজ দিয়ে হেবি করে কষতে হবে। নামাবার আগে নুন টেস্ট করতে হবে। আমাদের পিকনিকের আগের দিন ক্লাসে আমি বললাম, “অজয় আদা রসুন কিনে রাখিস, পেঁয়াজ কিনিস, চিকেন আর ময়দা তো কিনবিই, আর মশলা কি আছে তোর কাছে?” মাল মাথা নেড়ে বলে “মশলা তো সব হ্যায়” হ্যায় যখন আর আমি মাথা ঘামালাম না। পরের দিন আমাকে ফোন করে সকালে বলে আদা কিনতে ভুলে গেছে, আর এক কেজি চিকেন কিনেছে।
যাওয়ার আগে কি মনে করে, দই, লঙ্কাগুঁড়ো আর আদাবাটা কিনে নিয়েছিলাম, ভাগ্যিস। গিয়ে দেখি অজয়ের রান্নাঘরের বাসন হল, একটা কড়া, একটা খুন্তি, একটা প্রেশারকুকার, একটা থালা, একটা বাটি, চাকি আছে বেলন নেই, গ্লাস আর একটা চামচ। আর মশলা? একটা ৫০০ মিলির কোকের বোতলে ওর মা একটা মশলা বানিয়ে পাঠিয়েছে, তার মধ্যেই জিরে, ধনে, হলুদ, লঙ্কা সব গুঁড়ো একসাথে মেশানো।
হ্যাঁ রে অজয়, তাহলে রোজ যে এত বলতিস, আজকে লৌকির সবজী আজ করেলার সবজী? অজয়ের বক্তব্য থেকে বুঝলাম রেসিপি সব সেম। সবজীকে চাকাচাকা করে কেটে তেলে ভাজো, তারপর মায়ের মিক্স মশলা আর নুন দাও, তারপর জল দাও।ব্যাস, সবজী রেডি, এবার ভাত, রুটি বা লুচি দিয়ে খেয়ে নাও।

রসুন বাটার কিস্যু পাওয়া গেল না। তাই রসুন ছাড়িয়ে গ্লাসের পিছন দিয়ে চাকিতে পিষে সেটাই মাখানো হল চিকেনে। জীবনে প্রথমবার চিকেন ধুলাম, ম্যারিনেট করলাম, ক্লাস টুয়েলভের ব্যাং কাটা মনে পড়ছিল।আর কি মনে করে অজয়ের মায়ের মিক্স মশলাও ম্যারিনেশনে দিয়ে দিলাম।(অবশ্য হলুদ, জিরে, ধনে কিস্যু ছিল না তাই কিছু একটা দিতেই হত)অজয়ের একটা ক্লিক্স ছোট্ট গোলুমোলু ওভেন। সে আবার হাইফ্লেম হয়না। এদিকে এক কেজি মাংস কড়াইতে উবুড়চুবুড়। গরম হতেই দুটো বেজে গেল। তারপর আমার আর ধৈর্য ছিল না, আমি প্রেশার কুকারে চিকেন পুরে সিটি দিলাম। এই কাজটি তারপর আর করিনি কখনো। আমি রান্না করছিলাম, আর অজয় আর সুশান্তা প্রেম করছিল? আজ্ঞে না মশাই, তারা ততক্ষণে ময়দা মেখে অন্তত ৫০-৬০ টা লুচি বেলেছে। আর চাকিতে রসুন পেষা হয়েছিল আগেই বলেছি, তাই প্রতি লুচিতে রসুনের গন্ধ। এর মাঝে অজয় বেরিয়ে কোক আর প্ল্যাস্টিকের গ্লাস কিনে আনল। সাড়ে তিনটে নাগাদ আমার মাংস শেষ হল। তারপর কড়ায় তেল চাপিয়ে অজয় লুচি ভাজা শুরু করল। আমি আর সুশান্তা অজয়ের খাটে ঘুম দিলাম। সাড়ে চারটেতে অজয় জানালো লুচি কমপ্লিট, কিন্তু সমস্যা হল থালা মাত্র একটা। খাব কি করে?

খবরের কাগজের উপরে লুচি নিয়ে আমরা মেঝেতে তিন দিকে বসলাম। একমাত্র থালার উপর প্রেশারকুকার থেকে মাংস নিয়ে রাখা হল।একমাত্র বাটিতে চিকেনের ছিবড়ে ফেলা হল।এবার হাতে খাওয়া। আর সে কি খাওয়া। পাঁচটায় দুপুরের খাবার খাচ্ছি, তখন একুশ বাইশ বছর বয়স, ভয়ঙ্কর খিদে। মাংস হেব্বি হয়েছিল, আজ অবধি অত দারুণ চিকেন হলই না। আমার কনফিডেন্স বেড়ে আকাশে। আরে কিছু ছাড়াই আমি হেবি রেঁধে ফেলেছি। যতটা পারি খেয়েছিলাম, তাতেও হাফ মাংসও তুলতে পারিনি, অজয় হতভাগা তিনদিন ধরে তিনবেলা করে খেয়েছিল, বাড়িওয়ালার ফ্রিজে রেখে রেখে।

আমি পরে দুইদিন হাত থেকে রসুনের গন্ধ পেয়েছি আর সমানে রসুন ঢেঁকুর তুলেছি।

Comments