ওরা দুইজন



- "মা,দেখ পিকু মারছে আমাকে"।

- "বড় দিদিকে মারে না পিকু"।

- "না মা আমি মারিনি,মিথ্যেবাদী পেঁচি কোথাকার"।

- "মা, দেখ আমাকে মিথ্যেবাদী বলছে"।

-"ধুত্তোর, তুই নিজে মিটিয়ে নে। আমার একগাদা কাজ আছে এখন"।

- "মিথ্যেবাদী পেঁচি! মিথ্যেবাদী পেত্নী "...

ভাইয়ের পিঠে সর্বশক্তিতে গুমগুম করে দুটো কিল মেরে কেঁদেকেটে নিজের ঘরে আশ্রয় নিলো মিঠু। এ বাড়িতে তার কেউ নেই,কিছু নেই। সেদিন যখন পিকু তার নতুন স্ট্রবেরি গন্ধওয়ালা ইরেজারটা নিয়ে নিয়েছিল,সেদিনও মা ওর পক্ষেই কথা বলেছিল। বলেছিল "তিন বছরের ছোট ভাই,নিয়েছে বেশ করেছে,মাধ্যমিক দিবি পরের বছর,এখন কি আর সামান্য রবাট নিয়ে ঝগড়া মানায়"? তখনই বোঝা উচিত ছিল মা কোনোকালে তার পক্ষে ছিল না থাকবে না। মা সবসময় ভাই এর পক্ষেই কথা বলে। আজকে সে বাবাকে বলবে, বলবেই বলবে।
সারাদিন কলেজে পড়িয়ে তারপর আরো দুটো টিউশানি করার পর এক ঘণ্টা ভিড় ঠাসা ট্রেনে কোনোমতে ঝুলে বাড়ি ফিরলেন বাবা,ফেরার সাথে সাথে নালিশ শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে গেল।
"হতভাগা ছেলে,আজকেও স্কুল যাসনি? তার উপর আজ আবার দিদির গায়ে হাত তুলেছিস? কতবার করে বলেছি বড় দিদিকে মারবি না,এমনিতেই মেয়েটা দুর্বল,মাসে পনের দিন ভোগে। মেরেই ফেলব আজকে। তুমি সরো, তুমি বাধা দিও না। তোমার আদরেই ছেলেটা জাহান্নামে যাচ্ছে। গত বছর ফেল করেছিল,হেডমাস্টারমশাইয়ের হাতে পায়ে ধরে প্রোমোশান হয়েছে,এবছর আবার ফেল করবে। আর আমি যেতে পারব না স্কুলে। আমি একজন প্রফেসর,আমার একটা সম্মান আছে। তোমার ছেলে যে ভাবে চলেছে ,তাতে ভ্যানওয়ালা হওয়া ছাড়া আর কোন ভবিষ্যৎ ওর নেই,জেনে রাখো। আজ রাতে খাওয়া বন্ধ ওর এই বলে দিলাম। রাতে খেতে দিয়েছ কি আজকেই ওর শেষ দিন এই বাড়িতে।"
বাবার হাতে মার খেয়ে চুপ করে পড়ে রইল পিকু। কাল মিঠুকে দেখে নেব। উফ, ভগবান এরকম বদ দিদি কেন দিলে? সারাদিন নিজে জ্বর হয়েছে বলে স্কুল যাবে না,তখন সব মাফ,আমি একদিন না গেলেই বাবাকে লাগাবে, আর মার খাওয়াবে।
বাবার খাওয়া হয়ে গেলে একটা সানকি তে দুটো রুটি আর একটু তরকারী নিয়ে সামনে ঝনাৎ করে রেখে দিয়ে মা বলল,"ছোট ভাইটার খাওয়া ঘুচিয়ে দিয়েছ তো? নাও এখন গেলো বসে বসে। আমার মুখে আর কিছু রুচবে না আজকে।"

চার বছর পর

মা বাবা দুজনেই আজ বাড়ি নেই,কলকাতা গেছে দুজনেই। ডাক্তার দেখাবে আর কি সব টেস্ট করাবে। পিকু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গেছে,এই সুযোগে অনিমেষ কে বাড়িতে ডেকেছে মিঠু। কতদিন পর একটু নিভৃত আলাপের সুযোগ ঘটেছে তাদের। আহ্লাদী গলায় মিঠু বলল,"এসেছ যখন,তখন দুপুরে খেয়ে যাও না। মা ভাত করে গেছে। আমি নিজে হাঁসের ডিম কষা করেছি। একটা বেশি নিয়েছি তোমার নাম করে"।
অনিমেষ তখন অনিমেষ নয়নে তাকিয়েছিল তার মিঠুর দিকে আর ভাবছিল শালার অনুপস্থিতিতে পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়া যায় কি না। এমনিতেই পিকু তাকে একদম সহ্য করতে পারে না। মিঠুর মতই তাকেও বিষ নজরে দেখে। একটু ঘনিয়ে বসে মিঠুকে জিজ্ঞাসা করল,"পিকু কখন ফিরবে গো"?
- "কি জানি। ও মশাইয়ের কিছু ঠিক নেই। এখন বিশ্বকর্মা পুজোর চাঁদার চক্করে ঘুরছে। ঘষে ঘষে ইলেভেনে উঠেও স্কুলে যাওয়ার নাম নেই মশাইয়ের। জানো, মাধ্যমিকে সেকেন্ড ডিভিশন আমাদের বাড়িতে কেউ কোনোদিন পায়নি, পিকু ছাড়া। বাবা তো আজকাল ওকে দেখলেই রেগে যায়"।
- "ধুর। ছাড়ো না ওসব কথা। কি মেখেছ বল তো, একদম স্ট্রবেরী আইসক্রিমের মত গন্ধ। ইচ্ছে করছে খেয়ে ফেলি"।
ধুড়ুম করে দরজা খুলে ঝড়ের মত পিকু ঢুকল বাড়িতে। বাঁদিকে আড়চোখে তাকিয়ে অনিমেষ আর মিঠুকে দেখেই নিজের ঘরে গিয়ে জোরে দরজা বন্ধ করে দিল। চমকে উঠে আলাদা আলাদা হয়ে বসল দুজনে। দরজা বন্ধ করার আওয়াজে অনিমেষ একটু হাসল। কিন্তু পরক্ষণেই হাসি শুকিয়ে গেল তার। বন্ধ দরজার ওপার থেকে পাড়া কাঁপানো সুরে বেজে উঠল ... “ব্রহ্মা জানেন। গোপন কম্মটি”। একবার শেষ হতেই আবার শুরু হল। এক লুপে বেজেই চলল... বার তিনেক শোনার পর বিব্রত মুখে অনিমেষ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,"আজ যাই। কলেজের এক স্যারের সাথে দেখা করতে কলকাতা যেতে হবে। উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে চলে গেল"।
পাক্কা দশবার ওই গান শোনার পর যখন বুঝল অনিমেষ চলে গেছে,তখন দরজা খুলে বাইরে এলো পিকু। মিঠু ভাত বেড়ে ডিম কষার তিনটে ডিম সহ পুরো বাটিটাই ধরে রেখে গেছে তার জন্য। ঘরে গিয়ে দেখে ,চুপ করে এক জায়গায় বসে আছে মিঠু। থমথম করছে মুখ,চোখে জলের দাগ।

- "কি রে খাবি না"?

- "তোর লজ্জা করে না আমাকে ডাকতে? অনিমেষ কে অপমান করে কি পাস তুই"?

- "যা বাবা আমি কি করলাম? গান শুনেই তোর আশিকের রাগ হল বুঝি"?

- "তুই যতই ওকে অপছন্দ করিস না কেন,বিয়ে ওকেই করব আমি"।

- "সে তুই কর না। ওকে কর,বা একটা মেথর কে কর,একই ব্যাপার। শুধু আমাকে তোদের ন্যাকামিতে জড়াবি না ব্যাস। বিয়ে করে বিদেয় হ বাড়ি থেকে,আমি বাঁচি"।

আরো চার বছর পর

গতকাল মিঠু আর অনিমেষের বিয়ে হয়ে গেল ধুমধাম করে। মায়ের একটু আপত্তি থাকলেও,বাবার প্রশ্রয়ে বিয়েতে কোন ঘাটতি নেই। আজকে মিঠু যাবে শ্বশুরবাড়ি। সকাল থেকে আশির্বাদ চলছে। দফায় দফায় কান্নাকাটির বৃষ্টি চলছে। বাড়ির সকলে মিলে গাড়িতে তুলে দিতে এলো মিঠুকে। গাড়িতে ওঠার ঠিক আগে মিঠু নতুন করে কান্না শুরু করল,"ভাই গেল কোথায়? ভাইয়ের সাথে একবার দেখা না করে কি করে যাব "? অনেক খোঁজাখুঁজিতেও চোখে পড়ল না তাকে। হাজারটা কাজের ভিড়ে হয়তো সে ভুলে গেছে তার চিরশত্রুর আজকে বিদায় নেওয়ার দিন। আর দেরি করা যাবে না, বারবেলা পড়ে যাবে, তাই সকলের তাড়ায় গাড়িতে উঠে বসল মিঠু। গাড়ি চলতে শুরু করল অতি ধীরে। গলির মুখে পৌঁছে গতি নেওয়ার সময়,অনিমেষ আলতো করে তাকে কনুই দিয়ে ঠেলল। মিঠু তাকাতেই ইশারায় তাকে জানলার বাইরে তাকাতে বলল। দুটো দোকানের মাঝে একটা ছোট্ট গলিতে দাঁড়িয়ে আছে পিকু। দুইচোখ তার ভেসে যাচ্ছে নীরব জলে।

Comments