সুর্যের সিক্রেট

সুর্যের কম্পিউটার মিস যে তার অত্যন্ত প্রিয় সেটা মিস জানতে পারেননি প্রথমে। আসলে পারবেনই বা কি করে, মিস সবে সবে একটা কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে এসেছেন, তাঁর কাজ হল সুর্যের মত ইস্কুলের ছেলেপিলে এবং আরেকটু বড় কলেজের দাদাদিদিদের প্রোগ্রামিং শেখানো। আগে মিস শুধু প্র্যাক্টিকালের সময়ে প্রোগ্র্যামিং না পারলে দেখিয়ে দিতেন। কিন্তু এইবছর সুর্য ক্লাস সেভেনেউঠেছে, ব্লু-জে শুরু হয়েছে, আগে পার্থ স্যার দেখিয়ে দিতেন, তিনি মিসের কাছে সুর্যকে পাঠিয়ে দিয়ে বলেছেন, "দেখ, একে সামলাতে পারো কিনা, মহা দুষ্টু ছেলে।"
সুর্যের যে একটু রাগ হয়নি তা নয়, সে এমন কিছু দুষ্টু বাচ্চা নয়, সেটা সবাই বুঝতে পারে না। সে শুধু অন্যায়ের সাথে আপোস করে না। এই তো সেদিন শান্তনু স্যার বললেন, "সুর্য চিউইংগাম খাচ্ছ কেন কম্পিউটার রুমে, যাও ফেলে আসো"। ইল্লি আরকি, বললেই হল, তখন সদ্য মুখে চিউইংগাম পুরেছে সে, মিষ্টি ভাবটা এখনো রয়ে গেছে, এখনই তো সেটা চেবানোর টাইম। কিন্তু শান্তনুস্যার নাছোড়বান্দা, সে তখন বাইরে গিয়ে চিউইংগামটা ফেলে আসার অভিনয় করল, কিন্তু টাকরায় চিউইংগামটা লাগানোই ছিল তখন। পরে একটু ফাঁকা হতে আবার রেলিশ করে চেবানো শুরু করেছে, আবার শান্তনুস্যার ধরে ফেললেন, এবার রেগেমেগে বললেন, "যাও ফেলে এসো, না হলে মা কে কমপ্লেন করব।" কি আর করে বেচারা, বাইরে গিয়ে চিউইংগামটা ফেলতে গিয়েই প্রতিশোধের কথাটা মনে পড়ল। করিডোরে সব্বার জুতো সাজানো রয়েছে, কম্পিউটার রুমে জুতো পরে ঢোকা মানা, ধুলো এড়ানোর জন্য। শান্তনুস্যারের জুতো চেনে সে, সুন্দর ভাবে সেখানে চিউইংগামটা ফেলে মোজা দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিলো। স্যারতো সেন্টার বন্ধ করে বাড়ি যাবেন রাত নটায়, তখন টের পাবেন। হৃষ্টচিত্তে ফিরে এসে স্যারকে মুখ হাঁ করে দেখিয়ে তারপর আবার প্র্যাকটিকাল নিয়ে বসল।
এর পর থেকেই গুজব রটে গেল যে সুর্য অতি দুষ্টু বাচ্চা, কেউ বুঝতে পারলই না যে কেন সে প্রতিশোধ নিয়েছে। যাই হোক, এই নতুন মিস খুব একটা রাগি না, এবং মাঝে মাঝে কম্পিটিশন করেন প্রোগ্রামিং নিয়ে, খুব একটা ভালো পারেন না যদিও, প্রায়ই সুর্য আগে সলভ করে ফেলে। তাড়াতাড়ি পড়া শেষ হয়ে গেলে মিস একটুখানি কোরেলড্র বা ফোটোশপ শিখিয়েও দেন। তখন বেশ রঙটং নিয়ে কাজ করা যায়।
বাবা আগেই মারা গেছেন সুর্যের। বাবাকে তার মনে পড়ে না বললেই হয়। মা আর দাদুর আদরে মানুষ সে। দিদাও ছিলেন, বছর দুইয়েক আগে মারা গেছেন। মা সারাদিন অফিসে থাকে, দাদুর কাছেই সে বেশিরভাগ সময়ে থাকে। মা আর দাদু দুইজনে মিলে একটা কম্পিউটার কিনে দিয়েছে, কিন্তু সেটা মা আর দাদুই বেশি ব্যবহার করেন। নামেই সুর্যের কম্পিউটার। বন্ধুদের মত কম্পিউটার গেম খেলার খুব ইচ্ছে হয় তার, কিন্তু দিনে মাত্র দুইঘন্টা সে কম্পিউটারের জন্য পায়।
বিকেলে তাকে মাঠে খেলতে যেতে হয়, দাদুর কড়া আদেশ। তা, খেলতে সে ভালোই বাসে,স্কুল থেকে ফিরে ফুটবল খেলে, ঘুড়ি ওড়ায়। বাড়ি এসে দাদুর সাথে টিভি দেখে, সেটাও এক ঘন্টা। তারপর পড়াশোনা। মা ফিরে আসার পর হোমওয়ার্ক চেক করে, তারপর যদি মা কে সন্তুষ্ট করতে পারে, তবেই কম্পিউটার। অবশ্য স্কুলের কাজ করার জন্য সে কম্পিউটারে বসার অনুমতি পায়, সেটা আলাদা অবিশ্যি। সেখানেই একটা ফোল্ডারে সে জমিয়ে রাখে তার সিক্রেট। ইন্টারনেট নেই তার বাড়িতে। কাজেই অন্য কোথাও রাখার অবকাশ নেই।
একদিন ইস্কুলের পর ক্লাস সেরে বাড়িতে এসেই দেখে দাদু বিষণ্ণ মনে বসে আছেন। তাকে দেখেই বললেন, "জানিস কম্পিউটারটা খারাপ হয়ে গেছে"। মনের মধ্যে ধক করে উঠল তার। এ বাবা, এবার কি হবে? কম্পিউটারের মধ্যেই যে তার সিক্রেট জিনিসপত্র আছে। সেইগুলো কোনমতেই হারালে চলবে না। তবু মুখে হাসি টেনে দাদুকে বলল, তাহলে সারালেই হয়। দাদু বললেন, তোর কম্পিউটার সেন্টারের শান্তনুস্যারকে আসতে বলেছি, সারিয়ে দেবে বলেছে।
এই রে, শান্তনুস্যারের সাথে তো ছত্তিসকা আখড়া, ( এই কথাটার মানে চিরস্থায়ী শত্রুতা, কালকেই টিভিতে সিআইডি দেখে শিখেছে)। তিনি এসে যদি সিক্রেট ফোল্ডার খুলে সব দেখে টেখে সবাইকে জানিয়ে দেন? বড়ই চিন্তায় পড়ল সুর্য।
একটু পরেই শান্তনুস্যার এলেন, কি একটা করে কম্পিউটার সারিয়ে দিলেন। কিছু দেখতে পেলেননা বলে হাঁফ ছাড়ল সুর্য। কিন্তু যাওয়ার আগে তিনি একটা মোক্ষম বাঁশ দিয়ে গেলেন। তিনি কম্পিউটারটা দেখে দাদুকে বললেন, "মেসোমশাই, আপনি এই কম্পিউটারটা ফরম্যাট করিয়ে নিন, তাহলে আরো ফাস্ট চলবে। আর ফরম্যাট করলে তো ফাইলপত্র সব মুছে যাবে, তাই দরকারী জিনিসপত্র অন্য কোথাও রাইট করে রাখুন। আমি পরশু এসে ফরম্যাট করে দিয়ে যাব।" বলে সুর্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, "কি রে, তোর ক্লাস আছে তো আজকে, চল আমার সাথে চল।" দাদু আবার কুড়ি টাকা দিলেন ফেরার সময়ে দুটো ডিভিডি কিনে আনার জন্য, দাদু ব্যাকআপ নেবেন নিজের আর মায়ের ফাইলপত্রের।
সুর্য স্পিকটি নট। দাদু বা মা কেউই জানেন না তার মহা সিক্রেট ফোলডারটির কথা। সি ড্রাইভের সিস্টেম ফাইলের মধ্যে সে লুকিয়ে রেখেছে সেই ফোল্ডার। সেখানে সবার হাত দেওয়া মানা। আগেরবার যে কাকু কম্পিউটার ইন্সটল করে দিতে বলেছিল, সেই কাকুই মানা করে দিয়েছেন।
শান্তনুস্যারের সাথে সেন্টারে আসার সময়, সে শুধু একবার জিজ্ঞাসা করল, "আচ্ছা, স্যার? ফরম্যাট করলে কি সি ড্রাইভের সিস্টেম ফাইলরাও ডিলিট হয়ে যায়?" শান্তনু স্যার বললেন, "সে তো হবেই।"
ফাইলের চিন্তায় মিসের কাছে সব ভুলভাল হয়ে গেল। শর্ত ছিল, সব ঠিকঠাক পারলে মিস দেখাবেন কি করে ফোটোশপে মাস্ক করতে হয়, কিন্তু একটা প্রোগ্রাম নিয়েই সে এতক্ষণ কম্পিউটারের সামনে চুপচাপ বসে থাকল, যে হাসিখুশি মিসও গম্ভীর হয়ে গেলেন।
"কি ব্যাপার রে? আজকে তোর একটুও মন নেই?" মিসের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা আইডিয়া এলো সুর্যের মাথায়। "মিস, তুমি কখন আসো এখানে?" মিস অবাক হলেন, তবুও উত্তর দিলেন,"সকাল এগারোটায়, কেন রে?" মিসের দিকে আরেকটু ঝুঁকে একটু চাপা গলায় সূর্য বলল, "তোমার কাছে পেনড্রাইভ আছে গো?" মিস আরো অবাক হয়ে বললেন "হ্যাঁ আছে, কেন কি হয়েছে বল না?" সুর্য বলল, "আচ্ছা আমি যদি আজকে তোমার পেনড্রাইভ নিয়ে যাই, আর কালকে স্কুল থেকে ফেরার সময়ে তোমাকে দিয়ে যাই, তাহলে ওর মধ্যে যা দেব সেটা তুমি একদম না খুলে দেখে রাখতে পারবে? আমি আবার পেনড্রাইভটা তোমার থেকে দুইতিনদিন পর নেব। তারপর খালি করে ফেরত দেব।" মিস বললেন, "কি থাকবে ওতে?" এবার প্রায় ফিসফিস করে সুর্য বলল, "আমার সিক্রেট। প্লিজ তুমি দেখো না, বা কাউকে দেখিও না। আমার বাড়ির কম্পিউটার ফরম্যাট হবে, আমি কোথাও রাখার জায়গা পাচ্ছি না।"
কি যেন ভেবে মিস রাজি হয়ে গেল। ক্লাসের শেসে মিস ব্যাগ থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করে দিতেই সুর্য ছুট দিল বাড়ির দিকে। সমাধান পাওয়া গেছে। রাতেই কপি করে ফেলল সিক্রেট ফোল্ডারটা। পেনড্রাইভটা লুকিয়ে রাখল স্কুলব্যাগে জিওমেট্রি বক্সে।সুর্যের মর্নিং স্কুল, শেষ হয় দেড়টা নাগাদ। ফেরার পথে মিসকে পেনড্রাইভটা ফেরত দিয়ে দিলো, আরো একবার বলল, "কি আছে একদম দেখবে না কিন্তু মিস। আমার কম্পিউটার ফরম্যাট হবে
কাল, শনিবার। সোমবারের ক্লাসে আমি আবার পেনড্রাইভটা নেব, আর মঙ্গলবার স্কুল থেকে ফেরার সময় ফেরত নেব।"
পেনড্রাইভ পেয়ে মিস পড়লেন মহা চিন্তায়। সুর্যের কথা ফেলতেও পারেন না, আবার চিন্তাও হচ্ছে যে সদ্য কৈশোরে পড়েছে এই ছেলে, একটু দুষ্টু হলেও, অত্যন্ত সরল মনের আছে এখনো, তার কি এমন সিক্রেট থাকতে পারে যে মা দাদু কাউকে একদম জানানো যাবে না? দুইদিন খুবই দুশ্চিন্তায় গেল, সোমবার সকালে পেনড্রাইভটা ব্যাগে পোরার আগে মিস ভাবলেন, আচ্ছা ফোল্ডারটা খুলে দেখা যেতেই পারে কি কি ফাইল আছে, ফাইলটা না খুললেই তো হল। নিজের কম্পিউটারে পেনড্রাইভটা ঢুকিয়ে দেখতে পেলেন, একটা মাইক্রোসফট এক্সেল স্প্রেডশিট আছে, মানে অঙ্ক খাতার মত, নাম হল মাই একাউন্টস, একটা ওয়ার্ড ডকুমেন্ট আছে, সেটার নাম মাই আম্বিশন, আর কয়েকটা ছবি। ছবিগুলো দেখতে গিয়েও দেখলেন না মিস, কি জানি, কি দেখে ফেলবেন, তারপর ছেলেটির প্রতি তাঁর স্নেহ আর থাকবে কি না, হাজার হলেও আজকালকার ছেলে।
অত্যন্ত কৌতুহল হলেও তিনি একটিও ফাইল খুললেন না। সুর্য ক্লাসে এসেই প্রথমেই প্রশ্ন করল, "মিস, দেখোনি তো?" মিস বললেন, "নাহ, দেখিনি। তবে তুই একটা কাজ কর, ফোল্ডারটা এই কম্পিউটারেও কপি করে রেখে যা, আমার কাছে, বাইচান্স যদি সেটা ডিলিট হয়ে যায়, তাহলে একটা কপি থাকবে।" আইডিয়াটা বেশ মনে ধরল তার। তবু জিজ্ঞাসা করল, "কেউ জানতে পারবে না তো? মিস বললেন, আরে, আমার ফোল্ডারে রেখে দিচ্ছি, কেউ খুলে দেখে না সেটা।" তাই হল, সুর্য নামে একটা ফোল্ডার খুলে, তার মধ্যে ফাইল গুলো রেখে দেওয়া হল। এই সময়ে মিস বললেন, "আমাকে কি দিবি? আমি যে এত হেল্প করলাম?"
এইরে, এটা যে হতে পারে, সেটা তো ভাবেনি সুর্য? বলল, "টিচার্স ডে তে সবথেকে ভালো পেনটা তোমাকে দেব।" মিস বলল, "তার ঢের দেরী, এখন কি দিবি?" সুর্য ভেবেচিন্তে বলল, "পকেটে একটা চিউইংগাম আছে।" মিস তাতেও রাজি না। শেষে সে বলল, "আচ্ছা বল কি চাই।"
"তোর ফাইলগুলোতে কি আছে দেখতে দিবি রে? কাউক্কে বলব না প্রমিস। দেখ, আমি আগেই দেখে নিতে পারতাম, কিন্তু জাস্ট তুই মানা করেছিস বলে দেখিনি।"
সুর্য খানিকক্ষণ ভেবে দেখল, তারপর বলল, "আচ্ছা দেখাব, যদি প্রমিস কর কাউক্কে বলবে না, মা বা দাদু কে নয়, স্যারদেরও না।"
"বলব না, প্রমিস।"
"আচ্ছা দেখো তাহলে" বলে দেখাতে শুরু করল ফাইলগুলো। ছবিগুলো হল ওর প্ল্যান করা সুপারহিরোর। ও নিজে ডিজাইন করেছে, পেইন্টে এঁকেছে, রঙ করেছে। দেখাতে দেখাতে মিসকে জানালো, কোরেলড্র আর ফোটোশপ শিখে গেলেই ও আরো ভালো করে আঁকতে পারবে আর কমিকস বানাবে। সেইজন্যেই ও সব পড়া মন দিয়ে করে ফেলে। যাতে আরো ভালো করে কোরেলড্র শিখতে পারে।
ডকু ফাইলে ভরা আছে ওর ভবিষ্যতের প্ল্যান। ও বড় হয়ে সিআইডি অফিসার হবে। তাই ও রোজ বাইরে খেলাধুলো করে, ও একদিন দয়ার মত শক্তিশালী আর এসিপি প্রদ্যুমন রাঠোরের মত বুদ্ধিমান হবে। তাই প্রতি এপিসোডে কে কি করেছে, কে কি বলেছে, কি ভাবে মার্ডার সলভ হয়েছে, সব পুঙ্খানুপুঙ্খ লিখে রেখেছে।
আর এক্সেল ফাইলটা? ওতে রয়েছে ঘুড়ির হিসাব। ও কত টাকা দিয়ে কি কি ঘুড়ি কনেছে, কতটা সুতো কিনেছে, আর কার কার কি কি ঘুড়ি কেটেছে।
হাসতে গিয়েও মিসের চোখে জল চলে এলো। ছাত্রের প্রতি অসম্ভব গর্ব অনুভব করলেন। ছেলেটা অত্যন্ত সরল, শুধু তাই নয়, তাঁকে বিশ্বাস করে সে এই ফাইলগুলো রাখতে দিয়েছে। তিনি প্রমিস করেছেন, ছেলেটির মা কে বা দাদুকে জানাবেন না। তিনি জানাননিও। শুধু প্রাণ ভরে আশির্বাদ করেছেন, যাতে সে বড় হয়ে খুব বড় সিআইডি অফিসার হতে পারেন, যিনি আবার অবসরে সুপারহিরো কমিক্সও বানাবেন এবং ঘুড়িও ওড়াবেন।

Comments