সুতপাদি

প্রতিটা বস্তুর সাথে কিছু না কিছু স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। প্রতিটি দিনের সাথে কখনো জড়িয়ে থাকে স্মৃতি, কখনো কিছুই থাকে না। পনেরোই আগস্ট এলে সবার আগে মনে পড়ে সুতপাদির কানমলা।
সুতপাদি আমাদের ইতিহাসের শিক্ষিকা ছিলেন। বয়স তখনই পঞ্চাশ হবে, না ও হতে পারে, কারণ জীবনে চুল কালো করেননি, তাই অর্ধেকের বেশি চুল সাদা ছিল। কাজেই ওঁর বয়স কত, আমরা কেউ জানতাম না। আমরা সবাই সমস্বরে ওঁকে ভয় পেতুম। পরীক্ষার খাতায় প্রতিটি বানানভুলে ১/৪ নম্বর করে কাটতেন। আমি গল্পের বই পড়ি বলে উনি আমাকে একফোঁটা স্নেহ করতেন, সেটা অনেক পরে বুঝেছি, সাধারণত উনি আমাকে খুবই ধমক দিয়ে বলতেন, "ব্ল্যাক টিউলিপ তো আর পড়োনি, তাহলে নেদারল্যান্ড এর অরেঞ্জ ফ্যামিলি সম্পর্কে আর জানবে কি করে" - অর্থাৎ, মা কে বলে ব্ল্যাক টিউলিপ বইটা পড়ো, তাহলে নেদারল্যান্ড এর অরেঞ্জ ফ্যামিলি বিষয়ে জানবে। এইভাবে বহু বইয়ের খবর ওঁর থেকে পেয়েছি, তবে সবই ধমকের দ্বারা পরিবেশিত।
ইতিহাস পড়াতেন যখন, সারা ক্লাস নিস্তব্ধ থাকত। চোখের সামনে ভেসে যেত একের পর এক ঘটনা। ঐতিহাসিক গল্প পড়ার উৎসাহ তৈরি করেছিলেন তিনি। খুব রাগী হলেও আমার অন্যতম প্রিয় একজন শিক্ষিকা ছিলেন।
তবে এই ঘটনা পনেরোই আগস্টের, এই ঘটনা কানমলার, এবং এই ঘটনা সুতপাদির এবং অবশ্যই আমার।

আমাদের ইস্কুলে প্রতিটা ফাংশন করত আলাদা আলাদা ক্লাস। পনেরোই আগস্টের ফাংশান করবে ক্লাস সেভেন। এবং কখনোই ক্লাস সেভেন এই বিষয়ে খুশি নয়। কারণ পার্টিসিপেন্টরা আর দিদিরা ছাড়া আর কেউ আসত না। ফাঁকা মাঠে গান গাইতে ভালোই বা লাগবে কেন। আর ছাত্রীরাও তেমন, ছুটির দিনে কেউ আসত না।
তবে আমাদের বেলায় ব্যতিক্রম হল, কারণ সেটা ১৯৯৭ সাল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পুর্তি। সুতপাদি ইতিহাসের শিক্ষিকা হওয়ার সাথে সাথে আমাদের শ্রেণীশিক্ষিকাও ছিলেন। তিনি ঠিক করলেন ক্লাসের সমস্ত ছাত্রী কিছু না কিছু করবে। এবং বড়দির থেকে প্রতি ক্লাসে নোটিস গেল, এই বছর সকলের আসা মাস্ট, না হলে বাম্পার কেস খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকো।
আমি তো মহা উৎসাহে সব কটা আইটেমে নাম দিয়ে বসে আছি। ওই একমাত্র অনুষ্ঠান যাতে আমি নাচ, গান এবং পাঠ তিনটেই করছি। বড় প্রোগ্রাম বানিয়েও দুই সেকশনের ২০-২৫ জনের বেশি মেয়েকে নেওয়া গেল না। দিদি তখন ঠিক করলেন নাটক করাবেন। ক্লাসে এসে একদিন হুঙ্কার দিলেন, নীলদর্পন কার বাড়িতে আছে? আমার হাতটা সটান মাথার উপর উঠে গেল। দিদি বললেন " তোমার কাছে তো থাকবেই, বেশি পাকা যে। " ( এটার আসল মানে হল, দিদি খুশি হয়েছেন )। পরের দিন বই আনলাম, দিদি বেছে নিলেন একটা অংশ, যেটা অভিনয় করা হবে।
আমার তৎকালীন বেস্ট ফ্রেন্ড পৌলমী চ্যাটার্জি, যে নাকি সাংঘাতিক ছেলে ছেলে, তার দিকে একটা আঙ্গুল তুলে বললেন, " তুই পুলিশ ইন্সপেক্টর হবি।" পৌলমীর কিস্যু করার ইচ্ছে ছিল না, সে একটু গাঁইগুই করতেই বললেন, "তাহলে শাড়ি পরে শাঁখ বাজানোর দলে চলে যা।" ওমনি সে শাড়ী পরার ভয়ে রাজি হয়ে গেল।
এরপর কাট টু পনেরোই আগস্ট, নাটকের জন্য ড্রেস ভাড়া করা হয়েছে। পৌলমীকে গোঁফ লাগানো হয়েছে। তার কুটকুট করছে এবং হেবি রাগ হয়েছে জগতের উপর, আমি হেবি হেসেছি, সে মুখে টুপি ঢাকা দিয়ে বসে আছে।
নাটকের আগে আমার পাঠ ছিল। পাঠ শেষ হলে নাটক শুরু হবে। পাঠ শেষ হল, আমি পাশে কে একটা ছিল, তাকে বললাম, পৌলমীকে গোঁফ লাগিয়ে যা কার্টুন লাগছে নাআ... সঙ্গে সঙ্গে কানে পড়ল টান। সুতপাদি সোজা কান ধরে পিছনে পাঠিয়ে দিলেন সাথে চাপা গলায় ধমক, "মাইকের সামনে বকবক করতে কে বলেছে?" দেখি আমি চলন্ত মাইকের সামনে বক্তব্য রেখেছি, এবং সারা স্কুল আমার কথা শুনেছে। পৌলমী জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে। নাটক শুরু হল তাই ঠ্যাঙ্গাতে পারেনি। পরে অবিশ্যি ভুলে গেছিল, নাটকে হেবি হাততালি পেয়েছিল তো। সেই ফাংশানটা পুরোটাই সেরা ছিল।
কিন্তু সেই কানমলা আমি আজ অবধি ভুলতে পারি না। পনেরোই আগস্ট এলে সবার আগে মনে পড়ে সেই কানমলা আর ধমক। আর মনটা খুব খুশি হয়ে যায় কেন জানিনা।

পুঃ জয়তী চক্রবর্তী, আজকের বিখ্যাত গায়িকা। তখন ক্লাস টুয়েলভে ছিলেন, এবং আমাদের কোরাসের আগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা "মিলে সবে ভারতসন্তান" গেয়েছিলেন। সেটাও প্রতি পনেরোই আগস্ট মনে পরে , কাঁটা দেয়।

Comments