ভাইফোঁটা

কলকাতাতে জন্ম এবং বড় হলেও আমি আসলে জয়নগরের মেয়ে। সেই জয়নগর, যেখানকার মোয়া নামকরা। বাবা জয়নগরের ছেলে। আর স্কুলে পড়াকালীন ছুটি পেলেই আমি জয়নগর পালাতাম। কত খেলার সুবিধা সেখানে। আমি সেখানে ঘুড়ি ওড়ানো শিখেছি, গলিতে চারজনে মিলে ক্রিকেট খেলেছি, ছোড়দিপিসির বাড়ির কাছে সবেদাবাগানে গাছে উঠেছি, রিংকিদিদির সাথে রাত একটা অবধি গল্প করেছি।
এমনকি আমার জেঠুর বাড়ি আমার নিজের থালা আর কোলবালিশ ছিল। আমি এলেই শুধু তারা বেরোতো। আমার মিনিমা হেব্বি কুরকুরে আলুভাজা করতেন, পিসিরা আমি নেমন্তন্ন খেতে গেলে উচ্ছেভাজা করবেনই। আর বেশের মেলা থেকে আমার নামে সবাই কিছু না কিছু খেলনা, ছবির বই, হারদুল কিনে রাখবেন। যাতে ছুটিতে আমি গিয়েই পাই সেইসব।



সত্যি বলতে বছরে দুদিন উপোস করতাম। সরস্বতীপূজা আর আজকে, ভাইফোঁটা। রিয়া নিয়ম করে শিশিরের যোগান দিত, সেই শিশির দিয়ে আমি বা রিংকিদিদি চন্দন বাটতাম। চার খেপে ভাইফোঁটা হত। প্রথমে টুমদিদির ঠাকুদ্দাকে আমরা নাতনীরা ফোঁটা দিতাম। পাঁচটাকার কয়েন পেতাম। তারপর বাবাদের ছয় ভাইকে ফোঁটা দিতেন চার পিসি। তারপর আমাদের সাত ভাইয়ের মধ্যে যতজন উপস্থিত ( পাঁচ ছজন হত) তাদের ফোঁটা দিতাম আমরা সাত বা যতজন উপস্থিত বোন। তারপর আমাদের পরের জেনারেশনের ফোঁটা। টুমদিদি বা রুম্পাদিদির মেয়েরা দাদাভাইয়ের বা দাদামণির ছেলে মেয়েকে ফোঁটা দিত।

চল্লিশ পঞ্চাশজন মিলে এক বিরাট হাহাহিহির পরিবেশ। সবাই সবার ভাইবোন নয়তো ছেলেমেয়ে। সবই ওপেন সিক্রেট। আর সবাই সবার পিছনে লাগত যাচ্ছেতাই ভাবে। দুপুরের মেনু বহু পরিকল্পনা অন্তে একই হত প্রতিবার। ভাত, ডাল, আলুভাজা, মলম (মেলায়েম ছ্যাঁচড়া), পার্শেমাছ, ভেটকিমাছ, চিংড়িমাছ, মাংস, চাটনি, পাঁপড়, মিষ্টি। তারপর বড়রা সবাই হাল ছেড়ে দিতেন আর বলতেন, ওরে একটু কোল্ডড্রিংক হবে না? আর পান?

মনে আছে, আমি রনি আর তুপাই একবার কোল্ডড্রিংক আনতে গিয়ে পাগলা গরুর তাড়া খেয়েছিলাম। সেটা আনতে হত সেই সিনেমাতলা থেকে। অনেকটা হাঁটা, কিন্তু কাজ দেখানোর উৎসাহে আমরা রাজি হয়ে যেতাম।

তারপরে সাধারণত সিনেমা দেখা হত। ওখানেই প্রথম বিছানার চাদরের ফাঁক দিয়ে ভরদুপুরে ভিরানা দেখা। বিকেলে আমরা কলকাতা ফিরব কারণ পরদিন থেকে বাবা মা আর আমার তিনজনেরই স্কুল খুলে যাবে। রনি এক ঘন্টা আগে থেকে মারা শুরু করত। ওটাই ওর মনখারাপের বহিপ্রকাশ। আর মিনিমাকে বলত, “ও মা, বুইয়ার মা কে বলনা, থেকে যেতে আজ”। আর আমি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে, বাধ্য হয়ে ফিরে আসতাম কলকাতা। আবার পরের বছরের (মাঝে যদিও আরো তিনটে ছুটি পরে) যাওয়ার প্ল্যান করে।

আজ সত্যিই বড্ড মনখারাপ। সকালে একটু ভ্যাঁও করলাম, হিংসেয় মেইনলি। বাবিকে বোনু ফোঁটা দিচ্ছিল আর ওদের বাপ্পাদাদা কত রোগা দেখে। আমার ভাইবোনেদের ট্যাগ করছি। পরের জেনারেশনকেও।

Comments