সুতন ও মানোরা

এটি লেখার আগে কিছু জ্ঞান ঝেড়ে দিই। থাই লোককথা হলেও এটি কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম এবং লাওসেও প্রচলিত। সাউথ এশিয়ান লোককথাও বলা যায়। আবার আমাদের দেশের হিমাচল প্রদেশেও একই গল্প প্রচলিত আছে সুধান এবং মনোহরা নামে। মনে করা হয় হিন্দুধর্ম যখন পুর্ব এশিয়ায় গেছিল তখন এই গল্পটিও গেছে। এমনকি এই গল্পটি বৌদ্ধধর্মীয় জাতকের গল্প বলেও অনেকে মনে করেন। বোরোবুদুরের স্তুপে এই কাহিনী খোদাই করা আছে।
বহুবার পড়েছি এই গল্প বিভিন্ন বইতে, বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন দেশের উপকথা হিসাবে।
এক দেশে এক শক্তিশালী সুপুরুষ রাজপুত্র ছিল, নাম ছিল তার সুতন। সে যেমন শক্তিশালী, তেমনই তার তীরধনুকের অব্যর্থ নিশানা। একদিন সে একা একাই গেছে বনে শিকার করতে। সারাদিন পরে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম করছিল সে নদীর ধারে, দেখে একদল কিন্নরী নেমে এসেছে সেই জলে স্নান করতে। গাছের আড়ালে লুকিয়ে সে তাদের দেখছিল। তারা তাদের ডানাওয়ালা আংরাখা খুলে রেখে জলে নেমেছিল। একজনকে দেখে খুব পছন্দ হল তার। সেই কিন্নরীর আংরাখাটি লুকিয়ে রেখে দিলো সে। সবাই এসে নিজের নিজের আংরাখা খুঁজে পেলেও একজন পেলো না। সবাই চলে যাওয়ার পরেও সে খুঁজতে লাগল কাঁদতে কাঁদতে। এইসময় সুতন তার কাছে এসে জানালো সেই লুকিয়ে রেখেছে আংরাখাটি।
-নাম কি তোমার? জিজ্ঞাসা করল সুতন।
- মানোরা। আমি কিন্নররাজের ছোটমেয়ে।
-আমাকে বিয়ে করবে? তাহলে ফেরত যেতে পারবে না ঠিকই, তবে তোমার আংরাখা তোমাকে ফেরত দিয়ে দেবো। অবশ্য বিয়ে করতে রাজী না হলেও ফেরত পাবে, ফিরে যেতে পারো বাবার কাছে।
সুতনের চেহারা দেখে আগেই মুগ্ধ হয়েছিল, এবার নরম কথা শুনে আরো মুগ্ধ হল মানোরা। হাত ধরে বলল সে সুতনের সাথে যেতে প্রস্তুত।
তাকে নিয়ে ফিরে এলো দেশে সুতন। কিছুদিন পরে ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল তাদের।আংরাখাটি রাখা থাকল এক আলমারিতে, মাঝে মাঝে সেটা দেখে মনখারাপ করলেও নিজের দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছে করত না মানোরার। রাজা রানীও এত সুন্দরী বৌমা দেখে মহাখুশী। স্বপ্নের মত কেটে গেল দুই বছর। কিন্তু চিরদিন কারো সমান যায় না। এক প্রতিবেশী দেশের রাজা আক্রমণ করলেন সেই দেশকে। বীর সুতন যুদ্ধে গেল, মানোরাকে নিজের বাবামায়ের দায়িত্ব দিয়ে, বাবা মা কেও বলল মানোরাকে যেন নিজের মেয়ের মত দেখেন তাঁরা। সকলে সানন্দে রাজী হল।
আনন্দে ছিল না কেবল এক বুড়ো সভাসদ। তার অনেক শয়তানি মানোরা ধরে ফেলছিল, তাই মানোরা ছিল তার দুইচক্ষের বিষ। সুতনের না থাকাকে কাজে লাগালো সে, ধীরে ধীরে রাজা ও রানীকে বোঝাতে লাগল মানোরা আসলে ডায়নী। না হলে রাজপুত্র সুতন বনের মধ্যে থেকে হঠাৎ এত সুন্দরী পেলো কি করে? আর এই যে রাজ্যে রাজ্যে অশান্তি তার কারণও মানোরা। দেবতা নাকি তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছেন মানোরাই এর কারণ।
এর উপায়? বৃদ্ধ রাজারানী দুর্বল হয়ে পড়লেন। একটাই ছেলে তাঁদের সে যদি যুদ্ধ থেকে ফিরে না আসে তাহলে কি করে চলবে? দুষ্টু সভাসদ বোঝালো, দেবতা বলেছেন মানোরাকে বলি দিতে হবে। তবেই রাজ্যে আবার শান্তি ফিরবে। যুদ্ধ শেষ হবে। মানোরা জানতে পারল সবই। তার মনের কথা পড়ার ক্ষমতা ছিল। রানী একদিন তাকে বুঝিয়ে বললেন আগামী কাল এক বিরাট পুজা যজ্ঞ হবে। তার মূল উদ্দেশ্য যুদ্ধের শেষ করা। সেখানে মানোরাকে বসতে হবে।আসল উদ্দেশ্য ছিল মানোরা বসার কিছু পরে সেই সভাসদ ইশারা করবে, আর পিছন থেকে জল্লাদ মানোরার মাথা কেটে ফেলবে।
পরের দিন খুব সুন্দর করে সাজল মানোরা। তাকে দেখতে লাগছিল ঠিক যেন স্বর্গের এক দেবী। রাজকীয় আংরাখা তারপোশাকের উপর পরে পুজায় বসল সে। তাকে দেখে রাজা রানীর চোখে জল এলো। সবার অলক্ষে লুকিয়ে পালালেন তাঁরা। নিজের চক্ষে কন্যাসমার হত্যা দেখতে পারবেন না তাঁরা। কিছু সময় পরে সেই সভাসদ ইশারা করতেই জল্লাদ তেড়ে এলো তার কুঠার নিয়ে। কিন্তু এ কি? রাজকীয় আংরাখার নীচে নড়ে উঠেছে মানোরার নিজস্ব আংরাখাটি। সে উড়তে শুরু করল। সবাই অবাক। রাজা রানীও ছুটে এলেন। রাজাকে দেখে মানোরা চেঁচিয়ে জানালো সুতন তাকে যদি খুঁজতে চায় তাহলে যেন উত্তরে গিয়ে কিন্নররাজের খোঁজ করে। বলে সে পাখা মেলে উড়ে গেল, ঠিক একটি বড় পাখির মতো।
আরো ছয়মাস পর যুদ্ধজয় করে ফিরে এলো সুতন। মানোরাকে দেখতে না পেয়ে মা বাবাকে জিজ্ঞাসা করল তার কথা। কাঁদতে কাঁদতে সব কথা জানালেন রাজা রানী। শুনে সবার আগে সেই সভাসদকে প্রাণদন্ড দিলো সুতন। তারপর ঠিক করল মানোরাকে সে ফিরিয়ে আনবে।
উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করল সে। এক মাস পরে দেখলো এক পর্বত। পর্বতের এক গুহায় আছেন এক সন্ন্যাসী। তিনি বললেন সুতন, “আমি তোমাকে সাহায্য করব মানোরাকে পেতে।”
আরো ছয়মাস সন্ন্যাসীর কাছে থেকে সুতন শিখল পশুপাখীর ভাষা। তারপর সন্ন্যাসীর আশির্বাদ নিয়ে সে আবার রওয়ানা হল। একদিন এক গাছের তলায় ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ শোনে দুই বিরাট পাখী নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে, ‘কিন্নররাজার ছোটমেয়ে মানোরার বিয়ে, সব পাখীর নেমন্তন্ন। কালই যেতে হবে।” এই শুনে সুতন লুকিয়ে দুই পাখির একটির পিঠে উঠে লুকিয়ে পড়ল। পাখী দুটি খুবই বিরাট হওয়ায় টের পায়নি। তারা পরদিন সকালে উড়তে লাগল উপরে আরো উপরে। এক সময় পৌঁছে গেলো কিন্নররাজের প্রাসাদে। সুযোগ বুঝে একসময়ে নেমে পড়ে রাজপ্রাসাদের একটি কুয়োর মধ্যে লুকিয়ে থাকল সে। কিছু সময় পরেই রাজকন্যার সাত সহচরী সেখানে রাজকন্যার জন্য বিয়ের আগের স্নানের জল নিতে এলো। সপ্তম কলসিটিতে তার হাতের আংটিটি ফেলে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সুতন।
রাজকন্যা মানোরা ফিরে আসার পর বাবাকে সব কিছু খুলে বলেছিলো। তার বাবা শুনে এক বছর অপেক্ষা করতে রাজী হয়েছিলেন। এক বছরেও রাজকন্যার স্বামী তাকে নিতে না আসায় রাজা আবার তার বিয়ে ঠিক করেছেন। রাজকন্যা মনমরা হয়ে বিয়েতে সায় দিয়েছিল, সেদিন বিয়ের অনুষ্ঠানের সব রীতিও পালন করছিলো। বিয়ের আগে স্নানের জন্য পরপর সাত কলস জল তার গায়ে ঢালা হলো।শেষ কলসির জল ঢালা হতেই আংটিটি গড়িয়ে পড়ল। রাজকন্যা চমকে উঠে সপ্তম সহচরীকে বললো, কোথা থেকে জল এনেছিস আমাকে সেখানে নিয়ে চল। সহচরী নিয়ে এলো রাজকন্যাকে। রাজকন্যাকে দেখে আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো সুতন। রাজকন্যা তার হাত ধরে দৃঢ়পদে হাজির হলো রাজার সভায়। প্রথমে তো একজন মানুষকে দেখে কিন্নররাজ মুন্ডচ্ছেদের আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজকন্যা যখন জানালো, এই তার স্বামী, তখন তিনি নিরস্ত হলেন। সুতনকে দেখে ভালো লাগল তাঁর। কিন্তু তিনি বললেন রাজকন্যাকে পেতে গেলে দুটি পরীক্ষা দিতে হবে সুতনকে। সুতন তাতেই রাজী।
প্রথমত তাকে অস্ত্র চালানোর পরীক্ষা দিতে হল। নিজের পছন্দমত অস্ত্র বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল, সে বেছে নিলো তীর ধনুক। সারা রাজ্যের মধ্যে সবথেকে দূরে তার তীরই পৌঁছল। দ্বিতীয় রাউন্ডে সে করল অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ। রাজা খুবই প্রসন্ন হলেন।
এবার দ্বিতীয় পরীক্ষা। সাতটি একই রকম দেখতে মেয়েকে সুতনের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। রাজা বললেন ‘নিজের স্ত্রীকে চিনে নিতে হবে তোমাকে”। সবাই একদম একরকম দেখতে। সুতন বেশ খানিকক্ষণ দেখেও কিছুই আলাদা করতে পারছিল না। হার স্বীকারের পুর্বমুহুর্তে সে দেখতে পেলো তার দেওয়া সেই আংটিটা আছে একজনের হাতে। এক মুহুর্ত দেরী না করে সে রাজাকে জানালো “ এই আমার স্ত্রী”। রাজা সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়তেই উধাও হল বাকী ছয় জন। মানোরাও আগের রূপে ফেরত এলো।
তারপর ধুমধাম করে কিন্নররাজার প্রাসাদে বিয়ে হয়ে গেলো দুইজনের। কিছুদিন কাটিয়ে দেশে ফিরে এলো তারা। এসে দেখেন ছেলের শোকে রাজারানীর কিছুদিন আগেই মৃত্যু হয়েছে। দুঃখের মধ্যেই অভিষেক হল নতুন রাজা রানীর। তারপর দেশের সব প্রজাকে তারা উপহার দিলেন কিছু না কিছু। সুখে কাল কাটতে লাগল তাদের।

পাঠের মতান্তর গুলি
------------------------
সুতন এবং মানোরা = সুধান এবং মনোহরা
কিন্নররাজকন্যা = পক্ষীরাজকন্যা
ঋষি = পর্যটক
বিরাট পক্ষী = ঈগল = ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী
এক বছরের অপেক্ষা মতান্তরে সাত বছর সাত মাস ও সাত দিন।
অনেকে মনেকরেন এটি প্রাচীন পাঞ্চালরাজ্যের উপকথা।

Comments