স্ট্র্যান্ডের ভুত

স্ট্র্যান্ডের ভুত
----------------------
শিবরাম চক্রবর্তীর প্লট, আমি নিজের মত করে আবার লিখেছি।
---------------------------------------------------------------
পড়াশোনার পাশাপাশি হাতখরচের জন্য তখন একটু আধটু লেখালিখি করি, একটা ম্যাগাজিনের প্রুফ রিড করে দিই। একদিন ম্যাগাজিনের সম্পাদক ডেকে পাঠালেন।আমার মত অকিঞ্চিতকর মানুষকে ডেকেছেন শুনে হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে গেলুম। উনি দেখি এক খানা কাগজ মন দিয়ে পড়ছেন। আমাকে দেখেই বললেন “বোসো।’ তারপর হাতের কাগজটা এগিয়ে দিলেন। দেখি সেটা একটা চিঠি। তাতে লেখা,

প্রিয় সম্পাদকমশাই
আমরা চন্দননগরের স্ট্র্যান্ডের ধারেপাশেই থাকি। ইদানিং ভুতের উপদ্রবে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। না মানে ভুতমশাই এমনিতে কোনো ক্ষতি করছেন না, তবে মাঝেমাঝেই হঠাৎ করে দর্শন দিয়ে ফেলছেন, তাতে আমরা খুবই আঁতকে আঁতকে উঠছি। এইভাবে কথায় কথায় আঁতকে ওঠা কি শরীরের পক্ষে ভালো? আপনি যদি দয়া করে এর কোনো প্রতিকার বলেন, বা চিঠিটা একটু আপনার ম্যাগাজিনে ছাপার ব্যবস্থা করে দেন, আর সেই চিঠি পড়ে যদি কোনো সহৃদয় পাঠক পাঠিকা আমাকে প্রতিকার বলতে পারেন তাহলে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
ইতি

-”তুমি তো বেকার মানুষ, মানে অন্যদের থেকে তোমার কাজ একটু কম, তাই তুমি এক কাজ কর, এই লোকটির থেকে একটু খবর জেনে এসো তো। চন্দননগরের বুকে ভুতের অনেক গল্প ঘোরাফেরা করে, কিন্তু ভুতের ইন্টারভিউ, থুড়ি, ভুতের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষের ইন্টারভিউ আমাদের ম্যাগাজিনকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাবে ভাবতে পারছ? না না, তুমি আজকেই ক্লাসের পরে চলে যাও।”
-”কিন্তু স্যার, এই চিঠিতে ঠিকানাই নেই যে। আমি কি করে ওঁকে খুঁজে পাবো?”
-”আহা, সে উনি যখন বলেছেন স্ট্র্যান্ডের ধারেকাছে, তখন ওদিকেই হবে। ওখানে আর কত বাড়ি আছে? কয়েকটা মাত্র, সবই তো প্রায় অনুষ্ঠানভবন বা স্কুল কলেজ। তুমি এক কাজ কর, স্ট্র্যান্ডের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করো। কোনো ম্রিয়মাণ মুহ্যমান লোক দেখলেই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ কর। আমার দৃঢ বিশ্বাস এভাবেই তুমি সেই ভদ্রলোককে খুঁজে পাবে।”
আমার মুখে আমার অনিচ্ছা প্রকাশ পাচ্ছিলো মনেহয়। অজান্তেই নাক শিঁটকোচ্ছিলাম এই বাজে আইডিয়া শুনে। আমার মুখ দেখে অবশেষে সম্পাদকমশাই নিজের পকেটে হাত দিয়ে আড়াইশো টাকা বার করলেন। আমাকে দিয়ে বললেন “এই নাও, ঘোরাঘুরির পর রেডচিলিতে গিয়ে চাউমিন আর চিলিচিকেন খেও।”
এতক্ষণে আমার একটু আনন্দ হল। এই বাজে কাজটা করার একটা যথার্থ কারণ পেলাম। আমি রাজি হয়ে বেরিয়ে গেলাম।
বিকেলে ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে সোজা স্ট্র্যান্ডে। মেঘলা বিকেল, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। সেইজন্য এমনিতেই স্ট্র্যান্ডে লোকজন কম। একবার এইমাথা থেকে ওইমাথা হেঁটে ঘুরে এলাম। কাউকে দেখে মনে হল না যে এ ভুতগ্রস্ত হতে পারে। সময় কাটানোর জন্য এককাপ লেংটি, বা লেমনটি মেরে দিলাম। তারপর একঠোঙা বাদামভাজা কিনলাম। বাদাম খেতে খেতে চারদিকে লোকেদের লক্ষ করতে লাগলাম, কিন্তু কাউকে দেখে ভুতুড়ে মনে হল না। বেশিরভাগই দোকা বা ততোধিক। কেউ আড্ডা মারছে, কেউ প্রেম করছে। একা প্রায় কেউই নেই। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে শুরু করেছে। স্ট্রীটলাইট জ্বলে উঠেছে, বৃষ্টিও একটু জোর হল এবার। টিপটিপ বরসা পানি থেকে একদম রিমঝিম ঘনঘন রে। ধুর, কোনো মানে হয় এইসবের? আমি রেডচিলির দিকে পা বাড়ালাম।
রেডচিলি চন্দননগরের কফিহাউজ। এখানে লোকেরা আড্ডা মারতে আর প্রেম করতে আসে। তবে এই বিচ্ছিরি ওয়েদারে সেখানেও প্রায় ফাঁকা। আমি একটা টেবিল দখল নিয়ে আগে এককাপ কফি অর্ডার দিলাম। তারপর চাউমিন আর চিলিচিকেন। খিদেও পেয়েছে জবর, তবে তার আগে একটু গরম হওয়া দরকার। বৃষ্টিতে যা ঠান্ডা হয়ে গেছি! প্রেম করার সুবিধার জন্যেই সম্ভবত রেডচিলিতে আলো অনেক কম। টেবিলগুলোর উপরে উপরে হালকা লাল আলো ঝুলছে। আর চার দেওয়ালে চারটে সুসজ্জিত ল্যাম্প, ব্যাস এটুকুই। একটু দূরে একটা টেবিলে একা একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। একা একা আর কি খাবো, আমি নিজেই ওঁকে বললাম কিছু মনে না করলে আমরা গল্প করতে করতে খেতে পারি। ভদ্রলোক বিনা বাক্যব্যায়ে আমার উল্টোদিকের চেয়ারে এসে বসলেন। মধ্যবয়সী একজন লোক, একটু ম্রিয়মাণ মনে হল। একদম আমি যেরকম লোক খুঁজছি। আলাপ করার ছুতোয় বললাম, ‘কফি খাবেন?” তিনি রাজি হলেন না, বললেন, ‘বরং আইসক্রিম খেতে পারি।” ভদ্রতার খাতিরে আমি নিজেই ওঁর অর্ডারটা দিয়ে দিলাম।
-“আপনি তো এই চত্বরের বাসিন্দাই মনে হচ্ছে?” ভদ্রলোক ইতিবাচক ঘাড় নাড়লেন।
-”আপনার কি মনে হয় স্ট্র্যান্ডের কাছাকাছি ভুত আছে?”
-”ধুর মশাই! কোন যুগে পড়ে আছেন আপনি? ভুত টুত কিচ্ছু নেই। আজকাল ভ্যাজালের যুগ চলছে, বুঝলেন কি না? আগে সব সরেস ভুতটুত থাকত, এখন থাকলেও সব মরেঝরে গেছে, সব ইহলোকগত হয়েছে বুঝলেন কি না?”
আমি বুঝলুম যে ওঁর মুদ্রাদোষ হচ্ছে “বুঝলেন কি না” বলা। আমার কফি শেষ করার আগেই তিনি আরেককাপ আইসক্রিম খেলেন।
বাপরে বাপ! আইসক্রিম কিছু খেতে পারেন ইনি। আমার চাউমিন চিলিচিকেনের ফাঁকেই সতেরোকাপ আইসক্রিম শেষ করলেন। তিনশবার “বুঝলেন কি না” বললেও কিছুতেই তাঁর মুখ থেকে আমি একটিও ভুতের কথা বার করতে পারলাম না। ভুতের প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি বলেন, “ধুর ধুর, ভুত কখনো এত আলোয় থাকতে পারে, এত শব্দের মধ্যে। কিচ্ছু নেই। এইসব যে রটাচ্ছে সে ভুল বলছে। বুঝলেন কি না?”
ইতিমধ্যে আড্ডায় আড্ডায় রাত প্রায় দশটা বাজে। রেডচিলি বন্ধ হওয়ার সময় এসে গেছে। অগত্যা আমি গেলাম বিল মেটাতে। বিল দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। প্রায় পনেরোশো টাকার বিল হয়েছে।
আমি দোকানের ম্যানেজারকে বললাম “এতো বিল কেন? আমি তো মোটে এক কাপ কফি খেয়েছি আর একপ্লেট চাউমিন আর চিলিচিকেন। তার জন্য দেড়হাজার টাকা?”
-“আর সতেরো কাপ আমাদের স্পেশাল আইসক্রিম? সেটা খেলো কে?” ম্যানেজার জিজ্ঞাসা করলেন।
আমি জানালাম, “আরে সে তো আরেকজন।”
-”আমাদের কি অন্ধ ভেবেছেন না ঘাসে মুখ দিয়ে চলি? আপনার টেবিলে তো আপনি একা বসে ছিলেন।”
-”কেন? ওই ভদ্রলোক?’ আঙুল দিয়ে দেখাতে গিয়ে দেখি উনি নেই। কিন্তু এরই মধ্যে গেলেন কোথায়?
এইবার ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছিলো না। আমি বুঝিয়ে ম্যানেজারকে বললাম, “দেখুন মশাই এইসব ইয়ার্কি আমার একদম ভালো লাগছে না। আমার কাছে মাত্র আড়াইশ টাকা আছে। সেই হিসাবেই আমি খেয়েছি। দেড় হাজার টাকা আমি কোথা থেকে দেবো? আমাকে বেচে ফেললেও ওই টাকা পাবেন না। “
-”তাহলে পুলিশ ডাকি? আজব লোক মশাই আপনি, খেয়েদেয়ে টাকা দিতে চাইছেন না।”
ওঁর ইশারা পেয়েই বয় কোথা থেকে একজন কনস্টেবলকে ধরে এনেছে।
সে কোনো কথাই শুনলো না, যাই বলি তার একটাই উত্তর। “থানেমে চলিয়ে। বড়াবাবু সব শুনেঙ্গে।”
আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চললো।
রেডচিলির বাইরেই দেখি সেই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এবার সাহায্যে এগিয়ে এলেন, আমার না, কন্সটেবলের। অন্য হাত ধরে তিনিও হিড়হিড় করে টানতে লাগলেন আমাকে।
এবার আমার ভারী বিরক্ত লাগল, “ধুত্তোর! আরে আমাকে ছোটবাচ্চা পায়া হ্যায়? দুজনে মিলকে হাত ধরে কিঁউ টানতা হ্যায়? আমি কি নিজে থানায় যেতে পারতা নেহি?”
কনস্টেবল বলল, - “আরে ম্যায়নে তো সিরফ আপকা এক হাত পকড়া হ্যায়। দুসরা কোই ইধর নেহি হ্যায়।”
কিন্তু ততক্ষণে আমি জ্ঞান হারিয়েছি।

Comments