বুটপরা পুষি


বুটপরা পুষি - বোহেমিয়ান রূপকথা
-----------------------------------------
(ছোটবেলায় পড়া, বড় হয়ে নিজের ভাষায় লেখা, একটু আধটু যোগও করেছি)

এক ছিল বুড়ো। তার ছিল এক গমপেষার কারখানা, একটা গাধা, একটা পুষি আর তিনটি ছেলে। বুড়ো মরার সময় বড় ছেলেকে তার গমপেষার কারখানা দিয়ে গেল, মেজো ছেলেকে দিলো গাধাটি এবং ছোটছেলে পুষিছাড়া আর কিছুই পেলো না।
বুড়ো মারা যাওয়ার পর, বড় দুই ভাই একসাথে কারখানা চালানোর কথা ভাবল, গাধাটিও সেই কাজেই লাগিয়ে দিলো। কিন্তু তারা ছোটভাইকে নিতে চাইলো না, কারণ তার না আছে পয়সাকড়ি, আর বাবার কাছ থেকে সে কেবল পুষিকে পেয়েছে, বাকী ভাইদের বক্তব্য পুষি কোনো কাজে লাগবে না, তাই তাকে এবং পুষিকে তাড়িয়ে দিলো তারা। পথের ধারে একা বসে কাঁদতে লাগল সে। এমন সময় পুষি তাকে স্বান্ত্বনা দিয়ে বলল, “কেঁদোনা তুমি, আমাকে একজোড়া বুট জোগাড় করে দাও, তাপ্পর দেখ কি হয়।” বেড়ালের মুখে মানুষের ভাষা শুনে তো ছেলেটি অবাক। তার কাছে যেটুকু টাকাপয়সা ছিল, তাই দিয়ে দুইজোড়া বুট কিনে পরিয়ে দিল পুষিকে, ব্যাস এবার সব টাকা শেষ। অল্প কিছু পয়সা রয়ে গেল। রাতের খাবারই জুটবে না। পুষি বলল, ওই পয়সা দিয়ে একটা বস্তা কিনে আমাকে দাও। আমি ঠিক খাবার জোগাড় করে আনব। তা সে কিনল এবং পুষিকে দিলো। পুষি ধাঁ।
বস্তার মধ্যে কিছু লেটুসপাতা ভরে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগল সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনটে দারুণ ভালো খরগোশ লাফাতে লাফাতে ফিস্টি করতে ঢুকে পড়ল বস্তায়। আর পুষিও বস্তা বন্ধ করে দৌড়। গ্রামে থাকত এক বুড়ি। রাঁধত দারুণ। কিন্তু একা একা কোথাও যাওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে। পুষি এলো তার কাছে। “বুড়িমা, তোমার তো দুটি ঘর, একটি দেবে আমার মালিককে থাকার জন্য? তার বদলে তোমার বাজার দোকান করে দেব। আর এই নাও দুটো খরগোশ, বেশ করে ঝোল কর দেখি, একটি তোমার, একটি আমার মালিকের। বুড়িতো সানন্দে রাজি হল।”
পুষি ছুটে গেল মালিকের কাছে। বাড়িও পেয়েছি, রাতের খাবারও। তুমি পথের শেষে বুড়ির বাড়িতে চলে যাও, খরগোশের ঝোল হবে আজ রাতে। আমি একটা কাজ সেরে এখুনি আসছি।
পুষির মালিক রওনা দিতেই পুষিও ছুট লাগালো সেই রাজ্যের রাজার প্রাসাদে। দরজায় বলল, দোর খুলে দেওয়া হোক, আমি রাজার জন্য উপহার এনেছি। পুষির মুখে মানুষের ভাষা শুনে হতভম্ব দারোয়ান দরজা খুলতেই পুষি একেবারে রাজার সামনে হাজির। ঝোলা থেকে তৃতীয় এবং সবথেকে ভালো খরগোশটা বার করে রাজাকে বলল “ এই নিন মহারাজ, আমার প্রভু কারাবাসের মার্কুইস, আপনার জন্য উপহার পাঠিয়েছেন।” বাস্তবিকই খরগোশটা খুবই ভালো ছিল, রাজামশাই তো খুবই খুশি হলেন, পুষিকে এক কাপ ঘন ভালো দুধ পুরষ্কার হিসাবে দেওয়া হল “তোমার প্রভুকে আমার ধন্যবাদ জানিও” রাজামশাই বললেন।
অভিবাদন জানিয়ে পুষি ফিরে গেল মালিকের কাছে।
পরের দিন আবার হাজির একটি খরগোশ নিয়ে, তার পরের দিন আবার। এইভাবে পুরো এক সপ্তাহ রোজ সে রাজাকে একটি করে খরগোশ উপহার দিলো। রাজাও খুব খুশি হলেন। সোমবার এলো, এইদিন রাজা তাঁর তাঁর রাজকন্যাকে নিয়ে রাজ্য ঘুরে দেখেন। তাঁর পরে তাঁর কন্যাই তো রানী হবেন। না শেখালে চলবে কেন?
পুষি এই কথা আগে থেকেই জানত।
ছুটে ছুটে মালিকের কাছে এসে সে বলল, “বনের মধ্যে চল।” মালিক বাধ্য ছেলের মত কথা শুনল পুষির। সে জেনে গেছে পুষি যা করে সব তার ভালোর জন্যই। তাই পুষি যখন বলল, নদীতে স্নান করে নিতে, বাধ্য ছেলের মত জামাকাপড় রেখে সে স্নান করতে গেল। পুষি তার জামাকাপড় লুকিয়ে রাখল এক বড় পাথরের নীচে। একটু পরেই রাজার ঘোড়াগাড়ী দেখা যেতেই সে চ্যাঁচাতে লাগলো, “বাঁচাও, বাঁচাও” রাজা গাড়ী থামালেন। এই তো সেই পুষি, যার মালিক রোজ একটি করে উপহার পাঠায়। “ কি হয়েছে?”
রাজার প্রশ্নের উত্তরে, পুষি কেঁদে ফেলে প্রায়। “আমার প্রভু কারাবাসের মার্কুইস জলে নেমেছেন স্নান করতে আর একদল দস্যু তাঁর সব জামাকাপড় নিয়ে পালিয়েছে, এবার কি হবে, ওঁর ক্র্যম্প ধরে যাবে, যদি ডুবে যান?না ডুবলেও এই ঠান্ডায় অসুখ হবেই।” এই ব্যাপার, রাজা তাঁর অনুচরদের বললেন, তাঁর একটা রাজকীয় পোশাক যেন এখুনি মার্কুইসকে দেওয়া হয়। মিলমালিকের ছেলেকে সেই রাজকীয় পোশাকে দেখাচ্ছিল ভালোই। আর রাজকন্যারও তাকে খুব পছন্দ হয়ে গেল। রাজা তাকে আমন্ত্রণ করলেন রাজপ্রাসাদে থাকার। সেও রাজি হয়ে গেল।
রাজআতিথ্যে এক সপ্তাহ থাকল মিলমালিকের ছেলে। রাজকন্যার সাথে ভালোই বন্ধুত্ব হল তার। রবিবার রাজা জানালেন মার্কুইসকে তিনি জামাতা করতে চান, তবে আগে একবার তার সম্পত্তি আর প্রাসাদ দেখতে চান তিনি। মার্কুইস কিছু বলার আগেই পুষি সম্মতি জানিয়ে দিল, “কালকেই চলুন দেখবেন” তবে আমি একটু আগে যাব, রাজা আর রাজকন্যার যথেষ্ট খাতিরদারির ব্যবস্থা করতে হবে।
মিলমালিকের ছেলের তো দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হচ্ছিল না, পুষি যদিও বলেছে, তবুও, হাজার হোক সে সামান্য পুষি, কি করবে সে? পুষি তাকে আশ্বাস দিলো, “চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হবে। শুধু আমি এসে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব, তবেই রওয়ানা হবে তোমরা।”
সকাল হতে না হতে পুষি বেরিয়ে পড়ল, সেই বনের ওপারে, যেখানে এই রাজ্যের শেষ। সেখানে সোনার ফসল ফলেছে, অনেক কারখানা আছে। কার সম্পত্তি এইসব? জিজ্ঞাসা করল সে। চাষী,রাখাল এবং শ্রমিকরা দেখালো, দূরে পাহাড়ের উপরে এক প্রাসাদ, সেখানে থাকে এক রাক্ষস, তারই সব সম্পত্তি।
“তাই নাকি?” গম্ভীরভাবে বলল পুষি। “শোনো সবাই, কিছুক্ষণ পরেই এখান দিয়ে রাজা যাবেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলে সবাই বলবে এই সম্পত্তি কারাবাসের মার্কুইসের। না হলে তোমাদের কুচিকুচি করা হবে।” প্রাণভয়ে রাজী হয়ে গেল সবাই।
প্রাসাদের পথে যেতে যেতে সবাইকে একই কথা শিখিয়ে দিলো পুষি। তাপ্পর প্রাসাদে গিয়ে দেখা করল রাক্ষসের সাথে। রাক্ষসের বেড়ালে সবিশেষ রুচি ছিল না রাক্ষসের তাই বেড়াল নির্ভয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “ আচ্ছা আমি শুনেছি তুমি নাকি এত চালাক যে সিংহ হয়ে যেতে পারো চাইলেই?” রাক্ষস এক মুহুর্তে সিংহ হয়ে গর্জন করল, “এই দ্যাখ।” পুষি বলল, “সে তো অনেকেই পারে, আমি জানতে চাই তুমি হাতির মত বিশাল হতে পারো কি?” আরেক মুহুর্তে হাতি হয়ে রাক্ষস বলল, “দ্যাখ পারি কি না, আমি সবকিছু হতে পারি” পুষি ঠোঁট উলটে বলল, “বড় জিনিস হওয়া খুব সোজা, কিন্তু ছোট কিছু, এই ধর ইঁদুর হওয়া না। আমার মনেহয় তুমি পারবে না।”
কি? এত বড় কথা? এক মুহুর্তে ইঁদুর হয়ে গেল রাক্ষস, “এই দ্যাখ পারি কি না। আমার মত কেউ -”
কথা শেষ হওয়ার আগেই ইঁদুরকে ধরে খেয়ে ফেলল পুষি। মানে রাক্ষস শেষ। তারপর প্রাসাদের সবাইকে শিখিয়ে দিলো, কারাবাসের মার্কুইসের কথা। রাক্ষসের অত্যাচারের থেকে বেঁচে সবাই তখন মহাখুশি। এক কথায় মেনে নিলো পুষির কথা।
পুষি তখন ফিরে এলো রাজপ্রাসাদে। এসে বলল, “সব ব্যবস্থা করে এসেছি, এবার চলুন। আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছি।” গহীন বন পার হয়ে গাড়ী চলছে। তাতে আছেন রাজামশাই, রাজকন্যা আর মার্কুইস। রাজার প্রশ্নের উত্তরে, চাষী, রাখাল, শ্রমিক সবাই জানালো এইসব সম্পত্তি কারাবাসের মার্কুইসের। রাজা অবশেষে মিলমালিকের ছেলেকে বললেন “তোমার তো খুব উচ্চমানের অনেক সম্পত্তি দেখছি” মার্কুইস লজ্জা পেয়ে চুপ থাকল। প্রাসাদের সামনে পুষি দাঁড়িয়ে আছে। রাজকীয় অভ্যর্থনার পর বিশাল এক খানাপিনা হল। রাজামশাইতো খুবই প্রসন্ন হলেন। সেই খানাপিনার শেষেই বিয়ের কথা ঘোষণা হল। এক সপ্তাহ পর বিয়েও হয়ে গেল। মার্কুইসকে রাজপুত্রের খেতাব দেওয়া হল।
আর পুষি? তার তো পোয়াবারো। আর জীবনে তাকে ইঁদুর ধরে খেতে হয়নি। তার জন্য রোজ সবচেয়ে সেরা ঘন দুধ আর সর বরাদ্দ হল। সেরা মাংসা, মাছ, আর তুলতুলে বিছানায়, নতুন রাজারানীর আদরে তার সুখে দিন কাটতে লাগল।

Comments