ময়ূর পেখম

“কত দেরী হয়ে গেল, এখনো পাঠশালা থেকে ফেরার নাম নেই! হতভাগা ছেলে হয়েছে একটা। ভাত ঠান্ডা হয়ে করকরে হয়ে গেল, এলে আজকে পিঠে দুইখান দেবো, তারপর খেতে পাবে।” দুধ ফোটাতে ফোটাতে আপনমনেই বকবক করছিলো বিনুমামী।
সন্ধ্যা প্রায় হয়, এমন সময় দেখা গেল নন্দু আসছে। “কি রে? এটা পাঠশাল থেকে আসার সময়?”
“তাড়াতাড়ি খেতে দিয়ে দাও মামী। বড় মাঠে ন্যাড়াপোড়া হবে বলে জঙ্গলে গেছিলাম সবাই মিলে, অনেক শুকনো কাঠ জোগাড় করে আনলাম। মামা আসেনি?”
“নাহ, মামার কি আর সময় আছে বল? সারাদিন তো ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত। তুই তাড়াতাড়ি স্নান করে আয় দেখি পুকুর থেকে, ভাত গরম বসাই।”
“আহ, এখন কে আবার পুকুরে যাবে, আর ভাতও গরম করতে হবে না। ঠান্ডা খেয়ে নিচ্ছি।”
“আবার বেশী কথা বলে, আচ্ছা স্নান করতে হবে না। কিন্তু ভাত গরমই খাবি, একটু বস, এখুনি গরম করে দিচ্ছি।”
“মামী! ও মামী!”
“হুঁ!”
“কি ভাবছ গো?”
“দেখ তো, তোর মামা এখনো এলো না। এদিকে আমার ঘি প্রায় তৈরি। শুধু ছেঁকে হাঁড়িতে ভরব। কাল দোল, বাসু ময়রা ঘি চেয়েছে, লাড্ডু বানাবে, একটু পরেই যে পৌঁছে দিতে হবে। অনেক টাকার জিনিস। “
“ও তুমি ভেবো না, আমি খেয়েই আবার বেরিয়ে যাবো কিন্তু। বড় মাঠে সবাই মিলে মস্ত লম্বা ন্যাড়া বানাচ্ছে, আমিও ওদের সাথে বানাবো, আর যাওয়ার পথে মামাকে মনে করিয়ে দেব। তুমি আমার কথা শোনো না, আজ জঙ্গলে জানো এক অদ্ভুত মানুষের সাথে দেখা হল।”
“ধ্যাত! জঙ্গলে মানুষ থাকে নাকি? আর তাছাড়া বুঝলি কি করে অদ্ভুত?”
“কেন, তুমিই তো কত গল্প কর মুনিঋষিরা বন জঙ্গলে থাকেন। আমার মা বাবা মরে গেছে তাই তোমার কাছে আছি, তুমি না থাকলে আমি তো জঙ্গলেই থাকতাম। আর সিংহ এসে আমাকে -”
“একদম অলুক্ষুণে কথা বলবি না নন্দু। এইটুকু ছেলে কি পাকা পাকা কথা দেখ। মা বাবা নেই তো কি? আমি তোর মা নই? আমি তোকে যত্ন করিনা?”
“আহা সে তো করই। সেই অদ্ভুত মানুষের কথা শুনতে হবে না তোমাকে। তোমার সময়ই নেই। সারাক্ষণ রান্না ঘরে থেকে কি যে কর কে জানে। আগে তবু বাড়ি থেকে বেরোতে, এখন জল আনতেও যাও না।”
“না না, বল তার কথা, কি করে বুঝলি অদ্ভুত?”
“সে আর বোলো না। বন্ধুদের সাথে জঙ্গলে গেছি, গিয়ে শুনি এক অদ্ভুত সুর। সেই সুর ধরে ধরে গিয়ে এই লোকটাকে দেখতে পেলাম।”
“ছি! এই শিখছিস পাঠশালায়? লোক বলতে হয়? ভদ্রলোক বল।”
“ওই হল, ভদ্রলোক। তা সেই ভদ্রলোকটি একা একা দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। রাজাদের মত পোশাক, কিন্তু সাথে কেউ নেই। নিজেই বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, আর নিজেই কাঁদছিলেন জানো, চোখ দিয়ে জল পড়ছিল অবিরাম। আমি গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কাঁদছ কেন কাকু? হারিয়ে গেছ?
সে বললে, না গো খোকাবাবু, হারাইনি। শুধু সেই সময়টা হারিয়ে গেছে।
এমন কেউ বলে? সময় কখনও হারিয়ে যায়? অদ্ভুত না? বল মামী, ও মামী! আবার কি ভাবছ?”
“হুঁউ! না রে, কিছুই না। তা তোর অদ্ভুত মানুষ আর কিছু বলল?”
“আমাকে একটা জিনিস দিয়েছে। রাধিকা নামে একজনকে দিতে বলল। কিন্তু আমি সেই নামের কাউকে চিনিনা, ও মামী তুমি একটু দিয়ে দেবে গো? আমি তো এখানকার মেয়েদের নাম জানিনা, কে রাধিকা, তাকেই চিনি না। দিয়ে দেবে একটু? এই ময়ুরপেখমটা দিয়ে দেবে গো? আচ্ছা কেউ কাউকে ময়ূরপেখম দেয়? এটা কি দেওয়ার মত জিনিস হল একটা? আমার খাওয়া শেষ, এই নাও ময়ূরপেখম, দিয়ে দিও কিন্তু। তুমি তো সবাইকে চেন বৃন্দাবনের। আমি চললাম, মামাকে বলে দেবো ঘি নিয়ে যাবে। আর এই অদ্ভুত ভদ্রলোকের কথা মামাকে বলো না কিন্তু, মামা আমাকে অচেনা লোকের সাথে কথা বলতে মানা করেছে। দিয়ে দিও কিন্তু রাধিকাকে, আমি কথা দিয়েছি ওই অচেনা লোক, থুড়ি ভদ্রলোককে? ও মামী! কথা বলছ না কেন?”
“হুঁ! হ্যাঁ বাবা দিয়ে দেব। তুই নিশ্চিন্তে যা। বেশী রাত করিসনি, মামা বকবে কিন্তু।”
নন্দু হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল।
ময়ূর পেখম হাতে চুপ করে বসে থাকলো বিনোদিনী।

Comments